শেয়ারআমেরিকা – ২৩ এপ্রিল ২০২০
পোলিও ও জলবসন্তসহ জীবনঘাতী অনেক রোগ নিয়ন্ত্রণে এমনকি নির্মূলে টীকা সহায়ক হয়েছে। এখন সন্ধান চলছে কোভিড-১৯ রোগ প্রতিরোধের টীকার। এই রোগ সারা বিশ্বে ২০ লাখেরও অধিক মানুষকে আক্রান্ত করেছে।
বিজ্ঞানীরা কোভিড-১৯’এর টীকা আবিষ্কারের যে পথে ছুটছেন তা আসলে বিশ্বব্যাপী সংক্রামক রোগের বিস্তার সীমিত করতে আমেরিকার সুদীর্ঘ প্রয়াসেরই ধারাবাহিকতা।
১৯৫৫ সালে আমেরিকার একজন ডাক্তার, চিকিৎসা গবেষক ও ভাইরাস বিশেষজ্ঞ জোনাস সিল্ক কর্তৃক পোলিও রোগের টীকা আবিষ্কারের আগ পর্যন্ত প্রতিবছর এই রোগে হাজার হাজার শিশু পঙ্গু হয়েছে। টীকা আবিষ্কারের ফলে সারা বিশ্বব্যাপী এই রোগ প্রায় নির্মূল হয়ে গেছে। যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (CDC)-এর তথ্যমতে ১৯৮৮ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে এই রোগে আক্রান্তের সংখ্যা ৯৯ শতাংশ কমে এসেছে।
১৯৬৩ সালে আমেরিকার একজন নোবেল বিজয়ী জৈব-চিকিৎসা বিজ্ঞানী জন এন্ডারস কর্তৃক হামের টীকা আবিষ্কারের আগ পর্যন্ত হামের কারণে সারা বিশ্বে প্রতি বছর মৃত্যুর সংখ্যা ছিলো আনুমানিক ২৬ লক্ষ। এখন হামের সংখ্যা ব্যাপকভাবে কমে গেছে; (CDC)-এর তথ্যমতে ২০১৮ সালে হামের কারণে সারা বিশ্বে মৃত্যুর সংখ্যা মোটামুটি ১৪২,০০০।
এখন কোভিড-১৯’এর নিরাময় সন্ধানে সম্মুখভাগে রয়েছেন আমেরিকার উদ্ভাবকগণ। প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, সম্ভাবনাময় যে তিনটি টীকা মানবদেহে পরীক্ষা শুরু হয়েছে তার মধ্যে দুটিই যুক্তরাষ্ট্রের গবেষকদের উদ্ভাবিত।
অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কোভিড-১৯’এর সম্ভাব্য টীকা উদ্ভাবনের কাজ চলাকালে ইউনিভার্সিটি অফ ম্যারিল্যান্ড স্কুল অফ মেডিসিনের একদল বিজ্ঞানী বিদ্যমান কোন টীকা যেমন পোলিও টীকা মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে এবং জীবন বাঁচাতে সক্ষম কিনা তা পরীক্ষা করে দেখছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের গবেষকেরা নিম্নবর্ণিত রোগগুলোর নিরাময় সন্ধানেও কাজ করছেন:
মিডল ইস্ট রেসপিরেটরি সিনড্রোম (MERS)

মার্স (MERS) ভাইরাস ২০১২ সালে আরব উপদ্বীপের মানুষের মধ্যে প্রথম দেখা দেয়ার পরে ২০১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ছড়িয়ে পড়ে। এই ভাইরাস (MERS-CoV) কীভাবে রোগ সৃষ্টি করে সেটা বিজ্ঞানীরা জানতে পেরেছিলেন এবং সম্ভাব্য টীকা প্রস্তুতের কাজ শুরু করেন।
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ অ্যালার্জি অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজেস (NIAID)-এর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে, কোভিড-১৯’এর সম্ভাবনাময় একটি টীকা দ্রুত এর ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে যেতে পেরেছে কারণ এটি মার্স (MERS) ভাইরাস নিরাময়ে প্রস্তুতকৃত সম্ভাবনাময় টীকা রূপান্তরের মাধ্যমে প্রস্তত করা হয়েছে।
ইবোলা

ইবোলা ভাইরাসের কারণে জ্বর, দেহাভ্যন্তরে রক্তপাত এবং মৃত্যু হতে পারে। এই ভাইরাস মানুষের শরীর নির্গত তরলের সংস্পর্শে অন্য মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। এর প্রাদুর্ভাব ঘটে মূলত আফ্রিকায়। অতি সম্প্রতি এটি কঙ্গো গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রে ছড়িয়ে পড়ে যেখানে ২০১৮ সাল থেকে ২,১০০’এর বেশী মানুষ মারা যায়।
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের ঔষধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান মার্ক কর্তৃক প্রস্তুতকৃত ইবোলা টীকার অনুমোদন দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপভিত্তিক ঔষধ নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলো। আগস্ট ২০১৮-এ এই রোগের সর্বশেষ প্রাদুর্ভাব শুরুর পর থেকে ইবোলা মোকাবেলায় একক ও বৃহত্তম দাতাদেশ হলো যুক্তরাষ্ট্র।
জিকা

মূলত মশার মাধ্যমে সংক্রমিত হয়ে ২০১৫ ও ২০১৬ সালে এই জিকা ভাইরাসের কারণে পশ্চিমা বিশ্বে হাজার হাজার শিশু জন্মগত ত্রুটি নিয়ে ভূমিষ্ট হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ডিফেন্স ডিপার্টমেন্টের ওয়াল্টার রিড আর্মি ইন্সটিটিউট অফ রিসার্চ জিকা ভাইরাসের টীকা আবিষ্কারে দ্রুত অগ্রগতি সাধন করেছে এবং ২০১৬ সালের শেষ দিকে এ রোগের সম্ভাব্য নিরাময় উদ্ভাবনে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু করেছে।
NIAID-এর বিজ্ঞানীরা একটি পরীক্ষামূলক টীকা প্রস্তত করেন এবং ২০১৭ সালের মার্চে একটি ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে এর পরীক্ষা শুরু করেন।
ম্যালেরিয়া

আরেকটি মশাবাহিত রোগ ম্যালেরিয়া যা ৩২০ কোটি বা বিশ্বের অর্ধেক মানুষকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে। ২০০৫ সালে প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ কর্তৃক যুক্তরাষ্ট্র প্রেসিডেন্টের ম্যালেরিয়া কার্যক্রম শুরু হওয়ার আগে এই রোগে আফ্রিকায় প্রতি বছর ৭,০০,০০০ মানুষ মারা যেত। ২০১৭ সাল নাগাদ এই মৃত্যুর সংখ্যা অর্ধেকেরও কম অর্থাৎ মোটামুটি ৩,০০,০০০-এ নেমে এসেছে।
ডিফেন্স ডিপার্টমেন্ট সম্ভাব্য টীকা উদ্ভাবনে কর্মরত ব্যক্তি-মালিকানাধীন কোম্পানিগুলোর সাথে সহযোগিতার ভিত্তিতে সম্প্রতি ম্যালেরিয়ার একটি সম্ভাবনাময় টীকার (candidate vaccine) ট্রায়াল পরিচালনা করেছে।
যক্ষ্মা

যক্ষ্মা ব্যাকটেরিয়াজনিত একটি রোগ যা ফুসফুসে আক্রমণ করে। আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি বা কাশির ফলে বাতাসে জীবাণু ছড়িয়ে পড়ার মাধ্যমে এটি একজনের থেকে আরেকজনের শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। এই রোগে বছরে ১৫ লাখ মানুষের মৃত্যু ঘটে যা বিশ্বব্যাপী সংক্রমণজনিত মৃত্যুর প্রধান কারণ এইডসকেও ছাড়িয়ে গেছে।
বিদ্যমান একটি টীকার কার্যকারিতা সীমিত। সে কারণেই NIAID টীকা ও চিকিৎসা বিষয়ক গবেষণা কাজে তহবিল প্রদান করে থাকে। সম্ভাবনাময় কয়েকটি টীকা প্রাণীদের ওপর পরীক্ষায় সাফল্য দেখিয়েছে এবং সেগুলো ক্লিনিক্যাল পর্যায়ে পরীক্ষাধীন রয়েছে। ৪০ বছরেরও বেশী সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য ও ঔষধ প্রশাসন ২০১৯ সালে তাদের তৃতীয় যক্ষ্মা নিরাময়ী ঔষধের অনুমোদন দেয়। এর ফলে একদা চিকিৎসা অযোগ্য বলে বিবেচিত রোগীদের মধ্যে আশার সঞ্চার হয়।