যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত আর্ল মিলার’র বক্তব্য “রোহিঙ্গা সংকট: পশ্চিমা, এশীয় ও দ্বিপাক্ষিক প্রেক্ষিত” বিষয়ে ওয়েবিনার

কানাডিয়ান হাই কমিশনর সাথে অংশীদারিত্বে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর পিস স্টাডিজ (সিপিএস) কর্তৃক আয়োজিত

 

২৪ আগস্ট ২০২০

(বক্তব্য প্রদানের জন্য প্রস্তুতকৃত)

 

আসসালামু আলাইকুম। শুভ সকাল।

রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে এবছর পুনরায় আলোচনা অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি’কে এবং যথাসম্ভব বিস্তৃত পরিসরে দর্শক-শ্রোতাদের কাছে পৌঁছাতে আজকের এই ওয়েবিনার আয়োজনে যৌথ পৃষ্ঠপোষকতা প্রদানের জন্য কানাডিয়ান হাই কমিশনে আমার বন্ধুদেরকে ধন্যবাদ জানাই।

বর্তমান রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকটের তৃতীয় বার্ষিকীর প্রাক্কালে আমরা বিশ্বজুড়ে উদ্বাস্তু মানুষের নজিরবিহীন পরিস্থিতি ও মানবিক সংকট প্রত্যক্ষ করছি। ২০২০ সালে বিশ্বব্যাপী প্রায় ৮ কোটি মানুষকে বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত করা হয়েছে। তাছাড়া কোভিড-১৯ মহামারীর ফলে তাদের অবস্থা আরো নাজুক হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্র গত বছর বিশ্বব্যাপী মানবিক সহায়তা হিসাবে ৯.৩ বিলিয়ন ডলার এবং শুধু গত দশকে বৈদেশিক মানবিক সহায়তা হিসাবে প্রায় ৭০ বিলিয়ন ডলার প্রদানের মাধ্যমে তাদের একক বৃহত্তম অবস্থান ধরে রেখেছে।

কোভিড-১৯’র প্রাদুর্ভাবের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র সরকার সারা বিশ্বে জরুরী স্বাস্থ্য, মানবিক, অর্থনৈতিক ও উন্নয়ন সহায়তা হিসাবে এই মহামারী মোকাবেলা প্রচেষ্টাসমূহে ১.৬ বিলিয়ন ডলার অনুদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। বাংলাদেশের জন্য ৫৬ মিলিয়ন ডলারেরও অধিক সহায়তাও এই হিসাবের অন্তর্ভুক্ত।

সংকটাপন্ন মানুষদের সহায়তার জন্য আমরা জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থা, ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অফ দি রেড ক্রস, আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা, জাতিসংঘ শিশু তহবিল, বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচী এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক বেসরকারী সংস্থাসমূহের সাথে কাজ করি। বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন মহৎ সহযোগী প্রতিষ্ঠানের সাথেও আমরা কাজ করি। এই দেশটি প্রায় ১০ লক্ষ উদ্বাস্তু রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জন্য নিজেদের হৃদয় ও দেশের সীমানা খুলে দিয়ে বিশ্বে মানবিকতা ও সৌজন্যের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।

তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে আমেরিকার একজন সরকারী কর্মচারী হিসাবে আমি এমন কিছুই করিনি যা আমাকে এই নিঃস্বার্থ ও নিবেদিত অংশীদারদের সাথে কাজ করার চেয়ে বেশি গর্বিত করে বা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাঁরা সত্যিই আমাদের মধ্যে সেরা।

রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনে গেলে এই সংকটের কারণ হিসাবে বার্মায় সংঘটিত অমানবিকতার রূপ প্রত্যক্ষ করে আপনার হৃদয় ভেঙ্গে যাবে। আবার এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের যে সাড়া এবং সহায়তাকারী দেশগুলোকে দেখে আপনি অনুপ্রাণিতও বোধ করবেন।

ঐক্যবদ্ধ কাজের মাধ্যমে আমেরিকার সহায়তা বিশ্বব্যাপী লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তু ও নাজুক জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছে যাচ্ছে।

এই সহায়তার আওতায় জীবন রক্ষাকারী খাবার, আশ্রয় ও স্বাস্থ্যসেবা, সুপেয় পানি, শিক্ষা ও জীবিকার ব্যবস্থা করা হচ্ছে এবং শিশু সুরক্ষা কার্যক্রম, নারীদের সুরক্ষা ও ক্ষমতায়নসহ আরো অনেক কার্যক্রম বাস্তবায়িত হচ্ছে। বিশ্বের সবচেয়ে নাজুক জনগোষ্ঠীর প্রতি এই অবিচল অঙ্গীকার যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা নীতিমালার গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এটি বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসেরও অন্যতম প্রধান অগ্রাধিকার।

এই অগণিত লক্ষ লক্ষ মানুষও আমাদের মতোই। তারাও কারো প্রিয় মা, বাবা, বোন, ভাই যাদের একসময় ঘর ছিলো, জীবিকা ছিলো- হয়তো তারা তরুণ শিক্ষার্থী ছিলো- তারা সবাই এখন সংগ্রাম করছে ও আশা রাখছে। আমরা সবাই যেমন নিজেদের ও পরিবারের জন্য ভালো ভবিষ্যতের আশা করি তেমনি এই ঝুঁকিপূর্ণ পৃথিবীকে আমাদের অনাগত প্রিয়জনদের জন্য বাসযোগ্য করে রেখে যেতে হবে।

রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পগুলোতে কোভিড-১৯ মোকাবেলার জন্য আমরা প্রতিদিন আমাদের অংশীদার প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছি। আমরা খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা কমিয়ে আনছি, জনসমাগমের স্থান ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে জীবাণুনাশক ও হ্যান্ড স্যানিটাইজার সরবরাহ ও বিতরণ করছি, জনসমাগমের স্থান ও প্রবেশদ্বারগুলোতে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা তৈরি করছি এবং আইওএম’র জীবিকামূলক কার্যক্রমের আওতায় প্রস্তুতকৃত মাস্ক বিতরণ করছি।

গত মার্চে বাংলাদেশ জয়েন্ট রেসপন্স প্ল্যান ২০২০’র উদ্বোধনীতে রোহিঙ্গা সংকটে অতিরিক্ত মানবিক সহায়তা হিসাবে যুক্তরাষ্ট্র ৫৯ মিলিয়ন ডলার প্রদানের ঘোষণা করে যার প্রায় ৫৫ মিলিয়নই বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ কার্যক্রমের জন্য।

২০১৭ সালের আগস্ট মাসে সহিংসতা বৃদ্ধির পর থেকে রোহিঙ্গা সংকট মোকাবেলায় মানবিক সহায়তা প্রদানে সর্বোচ্চ একক দাতা হিসাবে যুক্তরাষ্ট্র ৯৫১ মিলিয়ন ডলারেরও অধিক বরাদ্দ দিয়েছে যার প্রায় ৭৯৯ মিলিয়নই বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ কার্যক্রমের জন্য। কক্সবাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পসহ বাংলাদেশে কোভিড-১৯ প্রতিরোধ কার্যক্রমে সহায়তা হিসাবে ২২ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।

প্রকৃতপক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের সরকারী সহায়তার আওতায় বাংলাদেশের আশ্রয়দানকারী জনগোষ্ঠী এবং বার্মায় চলমান সহিংসতায় ক্ষতিগ্রস্তদেরকেও সহায়তা দেয়া হচ্ছে।

তবে আমরা জানি, এই সংকটের সমাধান শুধু মানবিক সহায়তার চেয়ে আরো বেশি কিছু।

শিক্ষা, জীবিকা ও কাজের দক্ষতা ব্যবহারের সুযোগ পেলে এই মানুষেরা তাদের জন্মভূমিতে ফিরে গিয়ে সেখানে সফলভাবে পুনরায় বসতি গড়ে নিতে ইচ্ছুক। আমার মতে, কোভিড’র এই প্রেক্ষাপটেও অবস্থা বিবেচনায় বার্মায় স্বেচ্ছামূলক প্রত্যাবাসনের প্রস্তুতি নেয়ার বিষয়টিকে একটি অগ্রাধিকার হিসাবে রাখা উচিত। এর ফলে উগ্রবাদ, অপরাধ প্রবণতা ও সমাজবিরোধী আচরণের ঝুঁকিও কমে আসবে।

বাংলাদেশের সীমানার বাইরে আন্তর্জাতিক মহলেরও দায়িত্ব রয়েছে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়ার। মানবাধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শন, নিরবচ্ছিন্ন মানবিক সুযোগ প্রদান, যুদ্ধবিরতি মেনে চলা এবং শান্তি প্রতিষ্ঠায় রাজনৈতিক সংলাপে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে আমাদেরকে অবশ্যই বার্মার ওপর চাপ অব্যাহত রাখতে হবে। এ ধরনের পদক্ষেপ নিউ ইয়র্ক, জেনেভা, দি হেগ এবং এখানে এই অঞ্চল থেকেও নিতে হবে।

শরণার্থীদের জন্য নিরাপদ, স্বেচ্ছামূলক, মর্যাদাপূর্ণ ও টেকসই প্রত্যাবাসনের পরিবেশ সৃষ্টির জন্য আমাদেরকে অবশ্যই বার্মার ওপর চাপ অব্যাহত রাখতে হবে। সেইসাথে প্রাতিষ্ঠানিক বৈষম্য ও অনাস্থা দূরীকরণে প্রয়োজনীয় কাঠামোগত পরিবর্তনের লক্ষ্যে কফি আনান’র নেতৃত্বে পরিচালিত রাখাইন রাজ্য বিষয়ক উপদেষ্টা কমিশনের সুপারিশসমূহ বাস্তবায়নে নতুন নতুন পদক্ষেপ উৎসাহিত করতে হবে।

রোহিঙ্গা ভুক্তভোগীদের জন্য ন্যায়বিচার এবং দোষীদের জবাবদিহিতা উৎসাহিত করতে যুক্তরাষ্ট্র শক্তিশালী পদক্ষেপ নিয়েছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনে জড়িত শীর্ষ সামরিক নেতাদের ওপর আমরা নিষেধাজ্ঞা দিয়েছি, জাতিসংঘের তদন্ত ব্যবস্থার প্রতি জোরালো সমর্থন জানিয়েছি এবং আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালত (আইসিজে)’র কার্যপ্রণালীতে অংশগ্রহণ উত্সাহিত করেছি। এ বিষয়ে বিশেষত অপরাধীদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে আমরা অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, গাম্বিয়া এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের অবিচল অঙ্গীকারের প্রশংসা করি।

এই সংকট মোকাবেলায় বাংলাদেশ একা নয়। আমাদের সবারই দায়িত্ব রয়েছে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয়দানে বাংলাদেশ সরকার ও এখানকার জনগণের উদারতার প্রতিফলন প্রদর্শনের।অব্যাহত মানবিক সহায়তা এবং দ্ব্যর্থহীন কূটনৈতিক সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে আমরা সেটা করতে পারি।

আমার বক্তব্য শেষ করার আগে নতুন ধারণা অন্বেষণের অংশ হিসাবে বিবেচনার জন্য আমি কয়েকটি প্রশ্ন রাখতে চাই:

  • শরণার্থীদের দুর্দশা লাঘবে স্বল্পমেয়াদে কী করা যেতে পারে? কোভিড’র সময়েও কি নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট সেবা, সুরক্ষা পরিষেবাদি, জীবিকামূলক কাজ এবং শিক্ষা কার্যক্রম পুনরুদ্ধার করা সম্ভব?
  • বাংলাদেশ সরকারের বোঝা লাঘব করতে তৃতীয় কোন দেশে বড় পরিসরে পুনর্বাসনের বিষয়টি বিবেচনা করা উচিত কিনা? শরণার্থীদেরকে ভাসান চরে সরিয়ে নেয়া কি এর সম্ভাব্য একটি বিকল্প হতে পারে?
  • এই সংকট সমাধানে এই শরতে অনুষ্ঠিতব্য বার্মার নির্বাচনকে সামনে রেখে সেদেশের সরকারকে ইতিবাচক পদক্ষেপ নেয়ার জন্য চাপ দিতে আন্তর্জাতিক মহলগুলো আরো কী করতে পারে?
  • প্রায় দশ লক্ষ শরণার্থীকে আশ্রয় দেয়ার বোঝা বাংলাদেশের সাথে ভাগ করে নিতে আমরা এই অঞ্চলে আর কী কী করতে পারি? সাগরে ভাসমান মরিয়া মানুষদের থেকে মুখ না ফিরিয়ে না নিয়ে, তাদেরকে উদ্ধার করে বাংলাদেশে ঠেলে পাঠানো ছাড়া আর কী করার আছে?

মানবিক সহায়তা প্রদান, কূটনৈতিক চাপ প্রয়োগ এবং রোহিঙ্গা সংকট মোকাবেলায় বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক তৎপরতায় অনুঘটক হিসাবে যুক্তরাষ্ট্র অব্যাহতভাবে নেতৃত্ব দিয়ে যাবে। কিন্তু আমরা সবাই জানি, এই প্রচেষ্টা নিতে হবে বিশ্ব সম্প্রদায়কে। আমি আশা করি আজকের মতো এ ধরনের সমাবেশের মাধ্যমে রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান অন্বেষণে আমাদের সাথে যোগ দিতে প্রতিটি দায়িত্বশীল ও ন্যায়নিষ্ঠ দেশের প্রতি আমাদের আহ্বানটি সত্যিই আরো জোরালো হয়ে উঠবে। প্রতিটি ন্যায়নিষ্ঠ পদক্ষেপের ফলে মানুষের জীবন বাঁচে। গত তিন বছরে আমরা সেটা প্রত্যক্ষ করেছি। আমরা এটাকেই সত্য বলে জানি।

ধন্যবাদ।