রাষ্ট্রদূত মিলারের বক্তব্য বাংলাদেশে জাতিসংঘের অভিবাসন বিষয়ক নেটওয়ার্ক
বাংলাদেশে মানব পাচার: বিশ্ব মানব পাচার বিরোধী দিবসে সংলাপ ওয়েবিনার
৩০ জুলাই ২০২০
আসসালামু আলাইকুম। শুভ সকাল।
ঈদের খুশী সবার জন্য! ঈদ মোবারক!
আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চলে কোন অনুষ্ঠানে খুব বেশী সংখ্যক বিশিষ্ট ব্যক্তির উপস্থিতিতে সবাইকে যথাযথভাবে সম্ভাষণ করা দুরূহ হলে বহুল ব্যবহৃত অসাধারণ একটি ক্ষমাসুন্দর বাক্যাংশ ব্যবহৃত হয়ে থাকে- আর সেটা হলো: সমস্ত রাষ্ট্রাচার পালিত হয়েছে বলে গ্রহণ করুন।
বাংলাদেশে জাতিসংঘের অভিবাসন বিষয়ক নেটওয়ার্ক’র সহকর্মীদের সাথে এখানে উপস্থিত থাকতে পেরে আমি আনন্দিত। আপনাদের সদয় আমন্ত্রণের জন্য ধন্যবাদ।
যুক্তরাষ্ট্রের নতুন রাষ্ট্রদূত হিসাবে আমার প্রথম উন্মুক্ত দাপ্তরিক অনুষ্ঠান কেমন হবে সেটা নিয়ে আমি অনেক চিন্তা করি। আমি মনে করি, সেই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আমার কার্যকালে আমার কাছে অন্যতম সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টিই উঠে আসা উচিত। বতসোয়ানাতে আমাদের দূতাবাসের অন্যতম প্রধান অগ্রাধিকার বিষয় ছিলো জাতীয় পর্যায়ে এইচআইভি/এইডস মহামারী মোকাবেলায় যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় সরকারীভাবে এইচআইভি পরীক্ষা করা। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশের জন্য সেটা ছিলো মানব পাচার প্রতিরোধে জাতীয় কর্ম পরিকল্পনার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন।
যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের অন্যতম প্রধান অগ্রাধিকার হলো মানব পাচার বিরোধী লড়াইয়ে আপনাদের সবার সাথে কাজ করা। কোভিড-১৯ মহামারীর প্রভাবের কারণে আমার কাছে এর গুরুত্ব অনেক বেশি বেড়েছে। আমরা জানি মানব পাচারকারীরা শিকার হিসাবে সবচেয়ে নাজুক মানুষদেরকে বেছে নেয় এবং তাদেরকে শোষণের সুযোগ খুঁজতে থাকে। মহামারীর কারণে সৃষ্ট অস্থিরতা এবং জরুরী সেবা পাবার সুযোগ কমে যাওয়ার অর্থ হলো দ্রুতহারে আরো বেশি সংখ্যক নাজুক মানুষ পাচারকারীদের অপকর্মের ঝুঁকিতে পড়া।
মানব পাচারের ফলে প্রায় আড়াই কোটি মানুষ তাদের স্বাধীন থাকার মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, দাসত্বের জীবন যাপনে বাধ্য হচ্ছে এবং শোষকের লাভের জন্য খেটে মরছে। এটি একটি বৈশ্বিক হুমকি যার জন্য বৈশ্বিক কার্যক্রম আবশ্যক।
সুতরাং আমি খুবই আনন্দিত যে, আজ এখানে মানব পাচার বিরোধী লড়াইয়ের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদারদের ব্যাপক একটি অংশের প্রতিনিধিদের দেখতে পাচ্ছি। এই অপরাধ প্রতিরোধে সরকার, নাগরিক সমাজ, মানবাধিকার কর্মী এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহের মধ্যে জোর সহযোগিতা প্রয়োজন।
আমাদের লড়াইয়ের অস্ত্র হিসাবে আইন প্রয়োগকারী কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ, মানব পাচারের ঘটনাগুলোকে আদালতে আনা, সামাজিক পর্যায়ে শক্তিশালী নেটওয়ার্ক তৈরি, উদ্ধার পাওয়াদের সুরক্ষা দেয়া এবং মানব পাচারের নেটওয়ার্ক অনুসন্ধানে বিভিন্ন দেশের মধ্যে সহযোগিতা জোরদার করা আবশ্যক।
আমার সৌভাগ্য হয়েছে আপনাদের অনেকেরই কার্যক্রম দেখার। আমি প্রত্যক্ষ করেছি আমাদের ঐক্যবদ্ধ কাজের অপ্রতিরোধ্য শক্তি। কারণ মানব পাচার বিরোধী লড়াইয়ে ঐক্যবদ্ধ হলে আমরা অর্জন করতে পারবো না এমন প্রায় কিছুই নেই। আমরা এটা প্রমাণ করবো।
গতকালই আমি যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়নকৃত প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে কৌঁসুলি ও বিচারকদের সাথে সাক্ষাৎ করেছি। নবগঠিত সাতটি মানব-পাচার বিরোধী ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে পাচারকারীদের তদন্ত ও বিচারিক প্রক্রিয়া বিষয়ক প্রশিক্ষণটি এ বিষয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
ইউএসএআইডি/বাংলাদেশ আমাদের সহযোগী সংস্থা উইনরক ইন্টারন্যাশনাল’র সাথে একটি সাড়ে ছয় বছর মেয়াদী কার্যক্রমে অর্থায়ন করেছে যার আওতায় আধুনিক কালের এই দাসত্বের ফলে একদা বিপদগ্রস্ত বা বিপর্যস্ত হওয়া মানুষের জীবন উন্নয়নে কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় স্থাপিত ছয়টি আশ্রয়কেন্দ্র এবং রোহিঙ্গা আশ্রয়ণ এলাকায় তিনটি নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্রের মাধ্যমে ইউএসএআইডি/বাংলাদেশ নিরাপদ আশ্রয়ণ, পরামর্শ প্রদান, আইনি সহায়তা এবং স্বাস্থ্য ও জীবিকা বিষয়ক সহায়তা প্রদান করছে। বিগত ছয় বছরে, ইউএসএআইডি পাচার থেকে উদ্ধার পাওয়া ২,৮০০’র অধিক মানুষকে সহায়তা দিয়েছে এবং পাচার বিষয়ক মামলাগুলোর আরো কার্যকর পরিচালনার জন্য ১,৪০০’র অধিক ফৌজদারি বিচারককে প্রশিক্ষণ দিয়েছে।
আমরা আরো অনেকভাবেই একসাথে কাজ করে যাচ্ছি। আমি আশা করি আমাদের আজকের এই সহযোগিতাপূর্ণ আলোচনার মাধ্যমে আমরা মানব-পাচার প্রতিরোধে নতুন নতুন প্রস্তাবনা ও ধারণা পাবো।
স্টেট ডিপার্টমেন্টের মানব পাচার বিরোধী প্রতিবেদন ২০২০-এ দেখা গেছে, বাংলাদেশের অবস্থান পর্যায় ২’র পর্যবেক্ষণ তালিকা থেকে পর্যায় ২-এ উন্নীত হয়েছে ।
বাংলাদেশকে অভিনন্দন- অভিনন্দন আপনাদের অনেককেই যারা পাচারকারীদের আইনের আওতায় আনতে এবং পাচারের শিকার মানুষদের মুক্তির জন্য অক্লান্তভাবে লড়াই করেছেন। বৈশ্বিক মানব পাচার বিরোধী লড়াইয়ে আপনারা এদেশের নায়ক। এ বিষয়ে জনমত গঠনে সাহসী ভূমিকা গ্রহণের জন্য আমি সাবেক পররাষ্ট্র সচিব হক’র প্রশংসা করি। এই লড়াইয়ে তাঁর ব্যক্তিগত নিষ্ঠা না থাকলে এই অর্জন সম্ভব হতো না।
আ লুটা কন্টিনুয়া- অর্থাৎ সংগ্রাম চলবেই। মানব পাচার পর্যবেক্ষণ ও প্রতিরোধে নিযুক্ত অ্যাম্বাসেডর অ্যাট লার্জ আমার বন্ধু রাষ্ট্রদূত জন রিচমন্ড ও আমি গত ২৬ জুন দি ডেইলি স্টার’র উপ-সম্পাদকীয় লিখেছিলাম। পরবর্তী কাজ হিসাবে আগামী কয়েক মাসে বাংলাদেশ সরকারের জন্য আমরা বিনীতভাবে চারটি সুপারিশ রেখেছিলাম। আমি জানি, এ অঞ্চলে তথা সারা পৃথিবীতে এই লড়াইয়ের আদর্শ হয়ে উঠতে জনাব শহীদুল এবং আমরা সবাই চাই বাংলাদেশকে পর্যায় ১’এ দেখতে।
আমাদের প্রথম সুপারিশ হলো, সাতটি মানব-পাচার বিরোধী ট্রাইব্যুনালকে পাচার মামলার বিচারিক প্রতিবন্ধকতা কমিয়ে আনার দায়িত্ব দিতে প্রয়োজনীয় সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করা – যাতে ন্যায়বিচারের জন্য ভুক্তভোগীদেরকে একদিনও অপেক্ষা করতে না হয়।
দ্বিতীয় সুপারিশ হলো পাচার থেকে উদ্ধার পাওয়া নারী-পুরুষ বা তরুণ-বয়স্ক সকল ভুক্তভোগীর জন্য সেবা জোরদার করা। এই প্রচেষ্টায় অনেক সুশীল সমাজ প্রতিষ্ঠান নেতৃত্ব দিয়েছে। আমরা দেখতে চাই ভুক্তভোগীদের সেবা এবং তাদের নিরাময় লাভে প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদানে সরকার এসব সহযোগী সংস্থার সাথে আরো নিবিড়ভাবে কাজ করছে।
তৃতীয় সুপারিশ হলো, বিদেশে কাজের জন্য গমনেচ্ছুদের সুরক্ষা প্রদান। আমাদের নিশ্চিত করতে হবে যে, বাংলাদেশ থেকে গন্তব্য কোন দেশে যাওয়ার পুরো প্রক্রিয়ার মধ্যে কোন অসাধু প্রতিষ্ঠান ও পাচারকারী চক্র যাতে কাজে নিয়োগের নামে বিরাট অর্থ হাতিয়ে নিতে শ্রমিকদের জন্য ফাঁদ তৈরি করতে না পারে। দেশ থেকে যাওয়ার আগেই পুরো বিষয় সম্পর্কে শ্রমিকদের অবগতি ও প্রস্তুতি নিশ্চিত করতে আমরা সবাই একসাথে কাজ করতে পারি। পাচারকারীদের ফাঁদে পড়ে শ্রমিকেরা ধরা পড়লে তাদেরকে সুরক্ষা দিয়ে দেশে ফিরিয়ে আনতে আমাদের প্রয়োজন কার্যকর সরকারী সুরক্ষা ব্যবস্থা।
চতুর্থ সুপারিশ হলো, ঘোষিত ও অঘোষিত যৌনপল্লীগুলোতে যৌনকাজের জন্য পাচার সংক্রান্ত অভিযোগগুলোর পূর্বাপর তদন্তের জন্য তাৎক্ষণিক ব্যবস্থাগ্রহণ। যৌনপল্লীতে জন্ম নেয়ার কারণে কাউকে বাণিজ্যিক যৌনকাজে বাধ্য করা যাবে না।
এ বছরটি যুক্তরাষ্ট্রের পাচারের ভুক্তভোগীদের সুরক্ষা বিষয়ক আইন এবং সেইসাথে মানব পাচার, বিশেষত নারী ও শিশু পাচার প্রতিরোধ, দমন ও এর শাস্তি বিধানে জাতিসংঘ কর্তৃক পালার্মো প্রটোকল গ্রহণের ২০তম বার্ষিকী। এই সন্ধির উদ্দেশ্য অর্জনে ১৫০টিরও বেশি রাষ্ট্রপক্ষের সাথে যুক্ত হওয়ায় আমরা বাংলাদেশকে সাধুবাদ জানাই।
আমার কাছে এই দু’টি বিষয়ের ২০তম বার্ষিকীর আহবানটি সুস্পষ্ট। আর সেটা হলো মার্টিন লুথার কিং’র ভাষায়, “প্রতিটি মানুষই সম্মান ও মর্যাদার উত্তরাধিকারী।”
আমাদের এই আধুনিক বিশ্বে মানব পাচার নামক দাসত্ব থাকতে পারে না – কোথাও না – কখনো না।
মানব পাচার বিরোধী লড়াইয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে আমরা আপনাদের সবার সাথে সহযোগিতার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করছি।
ব্যক্তিগতভাবে আইন প্রয়োগকারী কর্মকর্তা হিসাবে মানব পাচারকারীদের তদন্তকাজ পরিচালনা এবং তাদের হাতে হাতকড়া পরানোর ২৪ বছরের অভিজ্ঞতায় আমি জানি, এই সমস্যাটি কত জটিল ও কঠিন হতে পারে। সম্প্রতি পাচারের ভুক্তভোগী বাংলাদেশীদের মর্মান্তিক ঘটনাবলীর মাধ্যমে আমরা সবাই দেখেছি, মানব পাচারের নেটওয়ার্ক কতটা নিখুঁত, সুদূরপ্রসারী ও বিপজ্জনক হতে পারে। আমার আহ্বান থাকবে, আপনারা এই জোর লড়াই অব্যাহত রাখবেন। এই কঠিন কাজটি অসাধারণভাবে এগিয়ে নেয়ার জন্য আপনাদের প্রতি আমার সকল সম্মান, শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জানাই। যে সাহসিকতা নিয়ে আপনারা বাংলাদেশের নাগরিকদেরকে সুরক্ষা ও সেবা দিচ্ছেন সেজন্য তারা আপনাদের কাছে ঋণী থাকবে। আমরাও সবাই ঋণী আপনাদের কাছে।
ধন্যবাদ!