ন্যারেটিভস অফ জেন্ডার ডাইভার্সিটি গ্রন্থের
প্রকাশনা অনুষ্ঠানে
রাষ্ট্রদূত মিলারের বক্তব্য
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়- সেপ্টেম্বর ৪, ২০১৯
পেশকৃত বক্তব্য অনুযায়ী
আসসালামু আলাইকুম। নমস্কার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিত শিক্ষকবৃন্দ, বিশিষ্ট অতিথিগণ, ভদ্রমহিলা ও ভদ্রমহোদয়গণ, শুভ বিকাল। একাডেমিক গবেষণা উদ্বোধন ও ড. নাসরিনের ন্যারেটিভস অফ জেন্ডার ডাইভার্সিটি গ্রন্থের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পেরে আমি সত্যিই সম্মানিত বোধ করছি।
টেক্সাসের রাইস বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ফুলব্রাইট ফেলো হিসাবে সম্প্রতি আপনি ফিরে এসেছেন। টেক্সাসের হিউস্টন ও ডালাসে বিশাল বাংলাদেশী-আমেরিকান জনগোষ্ঠী রয়েছে। আপনি ড. নাসরিন চমৎকার সেই দেশটি দেখার অভিজ্ঞতা নিতে পেরেছেন জেনে আমি সত্যিই আনন্দিত। আপনি এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশিষ্ট শিক্ষক ও শিক্ষার্থীগোষ্ঠীর অংশ- যারা যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষা বিনিময় কার্যক্রমের প্রাক্তন শিক্ষার্থী। তাঁদের মধ্যে আরো রয়েছেন আপনাদের উপাচার্য এবং ইংরেজি, চারুকলা, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, আইন, পর্যটন ও আতিথেয়তা ব্যবস্থাপনা এবং প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহকর্মীবৃন্দ। তালিকাটি আসলে আরো দীর্ঘ।
লৈঙ্গিক বৈচিত্র্য ও হিজড়া জনগণের প্রতি সহনশীলতা ও ধারণা বৃদ্ধির বিষয়ে আপনার নিষ্ঠার জন্য আমি আপনাকে সাধুবাদ জানাই, ড. নাসরিন।
এ বছর আমরা যুক্তরাষ্ট্রের স্টোনওয়াল আন্দোলনের ৫০তম বার্ষিকী পালন করেছি। এই আন্দোলনে এলজিবিটিআই সম্প্রদায় ও সমর্থনকারীরা যৌন সংখ্যালঘুদের ওপর পুলিশী হয়রানি ও সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিলেন।
দু’জন কৃষ্ণাঙ্গ হিজড়া নারী মার্শা পি. জনসন এবং সিলভিয়া রিভেরা এই আন্দোলনের পথিকৃৎ ছিলেন। দু’জনই যৌন বৈচিত্র্যপূর্ণ জনগোষ্ঠীর অধিকারের কথা তুলে ধরেন এবং এই আন্দোলনের অংশ হয়ে ওঠেন- যা সামাজিক ও রাজনৈতিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের প্রতীক হয়ে উঠেছিল। শেষ পর্যন্ত, তাঁরা সরকারকে তাদের নীতি পরিবর্তনের দিকে চালিত করেন এবং এলজিবিটিআই সম্প্রদায়ের জন্য সাম্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অগ্রসর হন। নিউ ইয়র্ক সিটিতে যেখানে স্টোনওয়াল আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটেছিলো সেখানে এ বছর মার্শা ও সিলভিয়ার স্মৃতির প্রতি সম্মান জানিয়ে ভাস্কর্য স্থাপন করা হবে- যা হবে হিজড়া নারীদের সম্মানে স্থাপিত প্রথম স্থায়ী ও সরকারী স্মৃতিস্তম্ভ।
আমেরিকার সাংস্কৃতিক নৃ-বিজ্ঞানী মার্গারেট মিড যেমন বলেছিলেন, “কখনো সন্দেহ ক’রো না যে, চিন্তাশীল ও নিষ্ঠাবান নাগরিকদের ক্ষুদ্র একটি দলও পুরো বিশ্বকে পাল্টে দিতে পারে- এবং এটি ছিলো এযাবৎকালের একমাত্র ঘটনা যা সত্যিই সেটা সম্ভব করেছিলো।”
আমি জানি, বৈশ্বিক পরিবর্তনকামী শিক্ষার্থীদের মধ্যে ন্যায়বিচারের ধারণা প্রবল এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যেও তাই। এই ক্যাম্পাসের তরুণেরা বরাবরই নিপীড়নের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম করেছে এবং তাঁরা ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে।
কিন্তু বাংলাদেশ ও আমার নিজের দেশ’সহ বিভিন্ন দেশে যৌন ও লৈঙ্গিক বৈচিত্র্যপূর্ণ জনগোষ্ঠী ও তাদের সমর্থকেরা অবিরাম সংগ্রাম করে চলেছে। অনেক দেশে তারা তাদের মতামত প্রকাশ এবং কেবল নিজেদের পরিচয়ের জন্যই সহিংসতা, গ্রেফতার, হয়রানি ও হুমকির শিকার হচ্ছেন।
সুতরাং, আমি যদি পারতাম তাহলে আমি আজ সরাসরি তরুণদের সাথে কথা বলতাম। এই যে নাজুক ও ত্রুটিপূর্ণ বিশ্বে আমরা সবাই বাস করছি সেটার ভবিষ্যত আপনাদের হাতে। আপনারা এই কথাটা শুনেছেন যে, তরুণেরাই ভবিষ্যত, তাই না? আপনারাই বিশ্বের ভবিষ্যত নেতা। আসলে আপনারা বর্তমান বিশ্বেরই নেতা। বন্ধুরা, এখনই সময় এই মঞ্চে উপস্থিত মানুষদের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে নিজেদের মতামত প্রকাশ এবং নীতি ও মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে লড়াইয়ের জন্য সাহস নিয়ে এগিয়ে যাবার। মনে রাখবেন এবং সবসময় মনে রাখার চেষ্টা করবেন আমাদের সেই বন্ধনের কথা যা আমাদের ঐক্যবদ্ধ করে, কিন্তু পৃথক করে না। আপনার কল্পনা করুন সেগুলো কী- আমাদের সামষ্টিক মূল্যবোধ, তাই না? পারিবারিক, নাগরিক ও সামাজিক বন্ধন।
আমাদের সকলকে নিজ নিজ ব্যক্তিগত কুসংস্কারের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে। সৎভাবে ভাবলে আমরা দেখবো, আমাদের সবারই সেটা রয়েছে। আমাদের সকলকে সন্দেহ ও ভুল বোঝাবুঝির ঘূর্ণাবর্ত থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। দুঃখের সাথে বলতে হয় যে, এসবের ফলে- দেখতে বা কথা বলার ধরনে এবং উপাসনা বা ভালোবাসা প্রকাশে আমাদের থেকে আলাদা জনগোষ্ঠীকে আমরা পৃথক করে ফেলি।
আমি মনে করি, মৈত্রী স্থাপনের গভীর তাৎপর্যের কথা স্মরণে রাখাও জরুরী। প্রায়শই মুখ বন্ধ করে রাখা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর পক্ষে কথা বলার ক্ষেত্রে এই মৈত্রী আপনাকে সুরক্ষা ও সহায়তা দিতে পারে।
আপনার বা আপনার প্রতিনিধিত্বে এলজিবিটিআই বিষয়ে কর্মরত কোন দলের কোন সভা বা একত্র হওয়ার জন্য কোন জায়গার প্রয়োজনে যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসে আমার সহকর্মীদের সাথে যোগাযোগ করুন। আমরা আপনাদের মিত্র। আমরা হয়তো সহায়তা করতে পারবো।
সমাজের সকল শ্রেণিপেশা থেকে বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষিত বা স্ট্রেইট মানুষদের সহায়তা ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের এলজিবিটিআই আন্দোলন তাদের অর্জিত সাফল্যের অর্ধেকও অর্জনে সক্ষম হতো না। আমার ব্যক্তিগত নায়কদের অন্যতম হলেন আমেরিকার নাগরিক অধিকার কর্মী ও লেখক জেমস বল্ডউইন- যিনি প্রায়শই বলতেন, আমাদের প্রত্যেককেই আবারও নিজ নিজ কুসংস্কারের বিরুদ্ধে জয়ী হতে হবে। তিনি এটিকে নৈতিক উদাসীনতা এবং “অন্তরের মৃত্যু” হিসাবে বিবৃত করেছেন।
যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের কর্মী জুলহাস মান্নাস এবং তাঁর বন্ধু মাহবুব রাব্বি তনয় ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ মানবাধিকার কর্মী। ২০১৬ সালের এপ্রিলে তাঁদেরকে হত্যার ঘটনা আমাদেরকে বাংলাদেশের তথা আমাদের সবার বসতি এই পৃথিবীর সবার মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় সংগ্রামী মানুষদের নেয়া ঝুঁকির কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
দূতাবাসে প্রতিবছর আমরা তাঁদের স্মৃতির প্রতি সম্মান জানাই।
আমাকে বলা হয়েছে যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মূলমন্ত্র হলো, “শিক্ষাই আলো”। সেই বিশেষ ও বহুমূল্য শিক্ষার ধারক হিসাবে আপনাদেরকে অবশ্যই সেই আলো ব্যবহার করতে হবে- যেমন করেছিলেন জুলহাস ও মাহবুব এবং মার্শা ও সিলভিয়ার মতো মানুষেরা- সমস্ত অবিচার, বিদ্দেষ ও অসহিষ্ণুতার অন্ধকারের বিরুদ্ধে।
বল্ডউইন যেমন আমার দেশ সম্পর্কে লিখেছিলেন, “আমি এখনও বিশ্বাস করি, আমরা এই দেশটিকে এমন পর্যায়ে নিতে পারি যা আগে কখনো হয়নি। আমরা কেবল সংখ্যাকে গুরুত্ব দিই বিধায় আমরা বিভ্রান্ত হয়ে পড়ি। আপনার সংখ্যার প্রয়োজন নেই। আপনাদের দরকার উদ্যম। আর বিশ্বের ইতিহাসে সেটাই প্রমাণিত।”
পরিশেষে, আপনার জ্ঞান, সাহস ও প্রজ্ঞার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ, ড. নাসরিন। ধন্যবাদ আজ এখানে উপস্থিত সকল আলোর দিশারী ও চ্যাম্পিয়নদেরকেও।
ধন্যবাদ।