ঢাকা, বাংলাদেশ
২১ মার্চ ২০২১
লিখিত বক্তব্য:
আসসালামু আলাইকুম।
সবাইকে শুভ সন্ধ্যা! আমাকে অনুগ্রহ করে পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ, আইরিন!
“পরিবর্তনের জন্য এক হোন: মানব পাচার বন্ধ করুন” শীর্ষক এই কর্মশালার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আপনাদের সবার সাথে যোগ দিতে পেরে আমি সম্মানিত বোধ করছি। মনোমুগ্ধকর এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে যৌথভাবে আই-ক্যান ফাউন্ডেশন এবং যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস ও আমেরিকান কর্নার চট্টগ্রামের কর্মীদল।
মানব পাচার বিরোধী যুদ্ধের গুরুত্ব তুলে ধরতে এই সপ্তাহের চেয়ে ভালো কোন সময় আমি আর ভাবতে পারি না। কেননা এখন বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০তম বার্ষিকী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী এবং এ দেশের প্রতিষ্ঠাকালীন মূলনীতি ও মূল্যবোধ উদযাপিত হচ্ছে। জাতির পিতা এমন এক মহান বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছেন যেখানে সকলের অধিকার ও স্বাধীনতা আইনত সমানভাবে সুরক্ষিত।
বাংলাদেশে নিযুক্ত নতুন রাষ্ট্রদূত হিসাবে আমার প্রথম দাপ্তরিক উন্মুক্ত অনুষ্ঠানের বিষয় কী হবে সে ব্যাপারে আমি অনেক চিন্তা-ভাবনা করেছিলাম। আমি চেয়েছিলাম, প্রথম অনুষ্ঠানটি হোক আমার কার্যকালের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত কোন বিষয়ে। বৎসোয়ানাতে সেটা ছিলো একটা সরকারী এইচআইভি পরীক্ষা ব্যবস্থা কেননা সে দেশের এইচআইভি/এইডস মহামারী মোকাবেলায় সহায়তা প্রদানই ছিলো যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশে সেই অনুষ্ঠানটি ছিলো মানব পাচার প্রতিরোধে জাতীয় কর্মপরিকল্পনার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন।
মানব পাচার প্রতিরোধে আপনাদের সবার সাথে কাজ করার বিষয়টি এখনও যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের অন্যতম প্রধান অগ্রাধিকার। কোভিড-১৯ মহামারীর প্রভাবে এ বিষয়টি আমাদের জন্য আরো জরুরী হয়ে পড়েছে।
আমরা জানি মানব পাচারকারীরা তাদের শিকার হিসেবে সবচেয়ে নাজুক জনগোষ্ঠীকে বেছে নেয় এবং তাদেরকে শোষণের সুযোগ খুঁজতে থাকে। মহামারী সৃষ্ট অস্থিতিশীলতা ও জরুরী সেবা গ্রহণের সুযোগ কমে যাওয়ার অর্থ হলো এসব পাচারকারীদের ফাঁদে পা দেয়ার ঝুঁকিতে থাকা মানুষের সংখ্যা আরো বেড়েছে।
প্রতিবছর, আনুমানিক আড়াই কোটি পুরুষ, নারী ও শিশুকে বাণিজ্যিক যৌন শোষণ, শ্রমে বাধ্য করা ও শ্রম দাসত্বের কাজে ব্যবহারের জন্য কেনা বেচা করা হয়। বিশ্বের প্রতিটি দেশে মানুষকে শিকার বানিয়ে পাচারকারীরা বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার অর্থ হাতিয়ে নেয়। কোভিড-১৯’র মতোই মানব পাচার একটি বৈশ্বিক মহামারী যার বিরুদ্ধে লড়তে আমাদেরকে অবশ্যই একইভাবে বৈশ্বিক কার্যক্রম নিতে হবে।
মানব পাচারের ব্যাপকতা, জটিল প্রেক্ষাপট ও প্রভাব নিরসনে যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন দেশের সরকার, সুশীল সমাজ প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তিমালিকানাধীন খাত ও উদ্ধার পাওয়া ভুক্তভোগী নেতৃবৃন্দসহ আমাদের বৈশ্বিক ও বহুপাক্ষিক অংশীদারদের সাথে কাজ করতে অঙ্গীকারবদ্ধ।
বাংলাদেশে মানব পাচার প্রতিরোধের বিষয়গুলোকে বাণিজ্য, অভিবাসন ও মানবিক সহায়তা কার্যক্রমসহ অন্যান্য মূল নীতিমালার মধ্যে আরো ভালোভাবে সম্পৃক্ত করার লক্ষ্যে আমরা একসাথে কাজ করছি। মানব পাচার থেকে উদ্ধার পাওয়া মানুষদের জন্য সেবা জোরদারকরণে ইউএসএআইডি আশ্রয়ণ প্রকল্পগুলোর সাথে কাজ করছে যার মাধ্যমে গত ছয় বছরে পাচার থেকে উদ্ধার পাওয়া ৩,৩০০ মানুষ সহায়তা পেয়েছে। তদন্ত পরিচালনা ও পাচারকারীদেরকে বিচারের আওতায় এনে দোষী প্রমাণে সক্ষমতা বাড়াতে আমাদের ডিপার্টমেন্ট অফ জাস্টিস দল বাংলাদেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও বিচার বিভাগের সাথে কাজ করছে। তাছাড়া, মানব পাচার প্রতিরোধ, মোকাবেলা ও নিরসনে বাংলাদেশের প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়াতে আমাদের রাজনৈতিক শাখা সরকারের অনেক মন্ত্রণালয় ও সুশীল সমাজ প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে নিবিড় সহযোগিতার ভিত্তিতে কাজ করে থাকে।
গত ২০ বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অফ স্টেট বার্ষিক মানব পাচার প্রতিবেদন প্রকাশ করে আসছে। আরো বেশি সংখ্যক পাচারকারীকে বিচারের আওতায় আনা, পাচারের শিকার হওয়া মানুষদের সুরক্ষায় ভুক্তভোগীর চাহিদা ও তার মানসিক আঘাতের তথ্যের ভিত্তিতে যথোপযুক্ত সুরক্ষা প্রদান এবং এই অপরাধকে পুরোপুরি নির্মূল করার লক্ষ্যে এই প্রতিবেদনের উপাত্তসমূহ সরকারের হাতকে আরো শক্তিশালী করে।
গত বছর বাংলাদেশের অবস্থান পর্যায় ২’র পর্যবেক্ষণ তালিকা থেকে পর্যায় ২-এ উন্নীত হয়েছে। বিষয়টি মানব পাচার নির্মূলে গত বছর জুড়ে পাচার-বিরোধী ট্রাইব্যুনাল গঠন ও কাজের সন্ধানে বিদেশে গমনেচ্ছু বাংলাদেশীদের শোষণকারী নিয়োগ প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়াসহ সুচিন্তিত ও অর্থবহ পদক্ষেপ গ্রহণে বাংলাদেশের সফলতারই সাক্ষ্য দেয়।
আমাদেরকে আরো অনেক কাজ করতে হবে। আ লুটা কন্টিনুয়া- অর্থাৎ সংগ্রাম চলবেই। একজন আইন প্রয়োগকারী কর্মকর্তা হিসেবে আমি দীর্ঘ ২৪ বছর যাবৎ তদন্তকাজ পরিচালনা করেছি এবং পাচারকারীদের হাতে হাতকড়া পরিয়েছি। আমি জানি, এই সমস্যাটি কত জটিল ও কঠিন। আমি জানি, মানব পাচারের নেটওয়ার্ক কতটা নিখুঁত, সুদূরপ্রসারী ও বিপজ্জনক হতে পারে। বহু দূর দেশে পাচারের ভুক্তভোগী বাংলাদেশীদের মর্মান্তিক ঘটনাবলী আমরা সবাই দেখেছি।
সমস্যাটির ব্যাপকতা দেখে আমাদের মনে হতে পারে যে, পাচার বিরোধী আন্দোলনে কোন একক ব্যক্তির কোন ভূমিকা নেই অথবা এটা শুধু সরকার বা বড় সংস্থাগুলোরই কাজ। সেটা আসলে ঠিক নয়। “পরিবর্তনের জন্য ঐক্যবদ্ধ” হওয়ার মাধ্যমে আমি এই সন্ধ্যায় পর্দায় যেসব তরুণ-তরুণীকে দেখতে পাচ্ছি তারাসহ আমরা প্রত্যেকেই মানব পাচার নির্মূলে সহায়তা করতে পারি।
এ বিষয়ে আমি কয়েকটি পরামর্শ দিতে চাই।
প্রথমত, মানব পাচারের লক্ষণ ও সূচকগুলো সনাক্ত করুন। পরিবার, বন্ধু, সামাজিক প্রতিষ্ঠান বা উপাসনালয় থেকে বিচ্ছিন্ন কোন ব্যক্তির আবির্ভাব ঘটে কি? কী বলতে হবে না হবে সে বিষয়ে প্রশিক্ষিত বলে মনে হয় এমন কারো কি উদয় ঘটে? কিশোর বয়সী কেউ কি বাণিজ্যিক যৌন পেশায় জড়িত? কোন একটি সূচকের দ্বারা মানব পাচারের পূর্ণাঙ্গ ব্যাপ্তি নিরূপণ করা যায় না। তবে আমাদের স্বীকার করতে হবে যে, আমাদের চারপাশেই মানব পাচার ঘটছে এবং ভুক্তভোগীরাও আমাদের মধ্যেই আছে। পাচারকারীদের ফাঁদে পড়া ব্যক্তিদের দরকার আমাদের এই সচেতনতা। তখন তারা বুঝতে পারবে যে তারা এর শিকার হতে চলেছে। আমাদের সহমর্মিতা তাদেরকে ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে সহায়তা করবে।
দ্বিতীয়ত, কল করুন। বাংলাদেশের জরুরী হটলাইন নম্বর হলো ৯৯৯। এটা সপ্তাহে সাত দিনই, দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকে। জানুয়ারি মাসের শেষদিকে আমরা দৌলতদিয়ার একজন যৌনকর্মীর কথা জানতে পেরেছি যিনি তাঁর এক খদ্দেরের ফোন থেকে ৯৯৯ নম্বরে কল করে সহায়তা চেয়েছেন। এই নারীকে ফাঁদে ফেলে যৌন কাজের জন্য নেয়া হয়েছিলো এবং ২০,০০০ টাকায় যৌনপল্লীতে বিক্রি করে দেয়া হয়েছিলো। কল দিয়ে সহায়তা চাওয়ার কারণে যৌনপল্লীতে পুলিশ এসে শুধু তাকেই উদ্ধার করেনি, সাথে যৌনকাজের জন্য পাচার হওয়া আরো ১৩ জনকেও উদ্ধার করা হয়। বাংলাদেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থার এক অসাধারণ কাজ এটি। কিন্তু পুলিশকে এই পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগত হতে সেই একটা কলের দরকার হয়েছিলো। তাই সম্ভাব্য কোন মানব পাচারের পরিস্থিতি আঁচ করলে ৯৯৯ নম্বরে কল করুন।
তৃতীয়ত, নিজ জনসমাজের সাথে সম্পৃক্ত হোন। বাংলাদেশের সকল জেলায়, অধিকাংশ উপজেলায় এবং এমনকি কিছু ইউনিয়নেও কাউন্টার ট্রাফিকিং কমিটি বা সিটিসি নামে পাচার বিরোধী কমিটি রয়েছে। মানব পাচার বিরোধী লড়াইয়ে তৃণমূল পর্যায়ের প্রচেষ্টার হৃৎস্পন্দন হলো এই সিটিসি। এটা একটা সেরা চর্চা যা আমরা যুক্তরাষ্ট্রে অনুসরণ করার কথা বিবেচনা করতে পারি। এই কমিটিগুলো তাদের নিকটবর্তী এলাকাগুলোতে পাচারের ষড়যন্ত্রগুলো সনাক্ত করে এবং প্রতিবেশীদেরকে পাচারকারীদের খাটানো ফন্দি থেকে বাঁচায়। উদ্ধার পাওয়াদের জন্য দেয়া সুরক্ষা সেবার মূল্যায়ন এবং ভুক্তভোগীর চাহিদানুযায়ী যথোপযুক্ত সেবা নিশ্চিতকরণে তারা একে অপরের সাথে ও বেসরকারী সংস্থাগুলোর সাথে কাজ করে। পাচারকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাগ্রহণের দাবি জানাতে তারা স্থানীয় পর্যায়ের সরকারী কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগের মধ্যে থাকে।
চতুর্থত, এই কথাটা ছড়িয়ে দিন! সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তথ্য প্রচারের মাধ্যমে যে কেউই মানব পাচার বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করতে পারে।
মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র’র ভাষায়, “প্রতিটি মানুষই সম্মান ও মর্যাদার উত্তরাধিকারী।”
আমাদের এই আধুনিক বিশ্বে মানব পাচার নামক দাসত্ব থাকতে পারে না – কোথাও না – কখনো না।
তাই, থেমে থাকবেন না, কাজ চালিয়ে যান। শক্তি নিয়ে লড়াই চালিয়ে যান। আপনারাই বীর। আপনাদের অপ্রতিরোধ্য বীরোচিত শক্তিই মানব কল্যাণের চাবিকাঠি।
ধারাবাহিক এই কর্মশালা আয়োজনের জন্য আই-ক্যান ও আইরিন’কে এবং এর আমন্ত্রণকারী হিসেবে ঢাকাস্থ আমেরিকান সেন্টারের কর্মীদেরকে ধন্যবাদ! আগামী পাঁচদিন যেসকল বিশেষজ্ঞ উপস্থাপনা করবেন তাঁদের সবাইকে আমি ধন্যবাদ জানাই। এই সন্ধ্যায় ও এ সপ্তাহের কর্মশালাগুলোতে যোগ দিয়ে মানব পাচার প্রতিরোধ যুদ্ধে আপনাদের স্ব স্ব গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য আপনাদের প্রত্যেককে ধন্যবাদ।
অনেক ধন্যবাদ।