শুভ বিকাল, মাননীয় মন্ত্রী শাহরিয়ার, বিশিষ্ট অতিথিবৃন্দ, অংশীদার, সহকর্মী ও গণমাধ্যমের বন্ধুগণ।
যুক্তরাষ্ট্র সরকারের পক্ষ থেকে আজকের এই প্রদর্শনীর উদ্বোধন করতে পেরে আমি সম্মানিত বোধ করছি যেখানে দুই মহান দেশ যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের মধ্যে ক্রমপ্রসারমান যাত্রার আদি থেকে শুরু করে এর বিভিন্ন পথরেখা তুলে ধরা হয়েছে। এই প্রদর্শনীর মধ্য দিয়ে এগিয়ে যেতে যেতে আপনি দেখতে পাবেন এগুলো শুধু অতীতের কিছু ঘটনার ছবি নয়, বরং এগুলো আমাদের দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্ক ও দু’দেশের মানুষের মধ্যেকার মেলবন্ধনের সাক্ষ্য যা সময়ের সাথে সাথে আরো শক্তিশালী হয়েছে।
এই দুই দেশের মধ্যেকার বন্ধুত্বকে তুলে ধরার লক্ষ্যে আয়োজিত এই আলোকচিত্র প্রদর্শনীর তত্ত্বাবধানে সহায়তার জন্য প্রায় দুই বছর আগে আমরা যুক্তরাষ্ট্রের অলাভজনক সংস্থা মেরিডিয়ান ইন্টারন্যাশনাল সেন্টারের সাথে এই বিশেষ সহযোগিতা কার্যক্রম শুরু করেছিলাম। ব্যাপকভিত্তিক ও সতর্ক গবেষণার মাধ্যমে আমরা শত শত ছবির মধ্যে থেকে ৫০টি ব্যতিক্রমী ছবি নির্বাচন করেছি যার প্রতিটির মধ্যে আছে একটি গল্প, তুলে ধরার মতো একটি বার্তা, আর আছে সেই বন্ধন যা আমাদেরকে একত্র করে রেখেছে।
আমাদের এই প্রদর্শনীর ভেতরে এগিয়ে যেতে যেতে আপনি দেখতে পাবেন বাংলাদেশী ও আমেরিকানদের মধ্যেকার নিত্যদিনের বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার আদি শেকড় সম্বলিত বিভিন্ন ছবি। ছবিগুলোতে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতারও আগে ১৯৪০ সাল পর্যন্ত শিল্পী, বিদ্যার্থী, স্থপতি, ডাক্তার ও উদ্যোক্তাসহ প্রথম দিকের অভিবাসীদের দেখা যাবে। অন্যদিকে আমাদের কাছে রয়েছে এমন সব ছবি যেখানে চিত্রিত হয়েছে কীভাবে অর্ধ শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে আমাদের দুটি দেশ ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা ও বিজ্ঞান, সংস্কৃতি ও প্রবাসী সম্প্রদায়, সহায়তা ও অবকাঠামো এবং কূটনৈতিক সহযোগিতায় সম্পৃক্ত রয়েছে।
আমি বাংলাদেশের প্রথম ও সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ সরকারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ড. এ কে নাজমুল করিমের ছবিটি তুলে ধরতে চাই। ১৯৫৩ সালে ড. করিম নিউ ইয়র্কের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সরকার ও সমাজবিজ্ঞান বিষয়ে দুটি স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জনের পর তিনি ইউনেস্কো ও ফুলব্রাইট কার্যক্রমের আমেরিকান শিক্ষাবিদ ড. জন ই. ওয়েনের সহায়তায় ১৯৫৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞান বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে গোপন করার কিছু নেই যে, বাংলাদেশের বহু মুক্তিযোদ্ধা এই বিভাগে বিদ্যার্জন করেছেন এবং স্বাধীনচিত্তে তাদের মুক্তির আকাঙ্ক্ষা তুলে ধরেছেন।
পুরো এই প্রদর্শনীটি আমদেরকে বারবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছে যে, ইউএসএআইডি’র সহায়তা কত দীর্ঘ সময় ধরে বাংলাদেশের মানুষের উপকারে আসছে। আপনি জানেন কি, প্রসিদ্ধ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়- বুয়েট প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ইউএসএআইডি’র সহায়তার ফলে? ইউএসএআইডি’র উদ্যোগের অংশ হিসাবে আমেরিকান স্থপতি জেমস ওয়াল্ডেন ১৯৬১ সালে ঢাকায় একটি স্থাপত্য ও পরিকল্পনা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন যা পরে বুয়েটে পরিণত হয়।
আজ এখানে উপস্থিত বুয়েটের প্রাক্তন শিক্ষার্থীদেরকে আমি ১৯৬১ সালে আমেরিকান অধ্যাপক ড্যানিয়েল ডানহ্যামের সাথে ডিজাইন স্টুডিও ক্লাসে উপস্থিত প্রথম শিক্ষার্থীদলের ছবিটি দেখার আমন্ত্রণ জানাচ্ছি।
আমরা সবাই “নলাকৃতি নকশার জনক” ড. ফজলুর আর. খানের রেখে যাওয়া মহান কর্মগুলো সম্পর্কে জানি। কিন্তু আপনি কি জানেন যে, তিনি বাংলাদেশের প্রথম ফুলব্রাইট বৃত্তিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থী ছিলেন? তিনি ১৯৫২ সালে যখন যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছিলেন তখন তিনি আমার নিজ রাজ্য ইলিনয়ে লেখাপড়া করেছেন।
শিক্ষায়তনিক আদান-প্রদানের মাধ্যমে আমাদের দেশদুটি যেভাবে বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধ হয়েছিল তার বহু অসামান্য উদাহরণের মাত্র কয়েকটি এখানে তুলে ধরা হয়েছে। এটি শুরু হয়েছিল ১৯৪০ সালের দিক থেকে অর্থাৎ বাংলাদেশের স্বাধীন দেশ হিসাবে আত্মপ্রকাশের ৩০ বছরেরও বেশি আগে।
দীর্ঘদিনের শিক্ষায়তনিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক অংশীদারিত্বের কারণে আমরা এখন গর্ব করে একথা বলতেই পারি যে, বাংলাদেশী শিক্ষার্থীরা যুক্তরাষ্ট্রকে তাদের উচ্চশিক্ষার জন্য শীর্ষস্থান হিসেবে বেছে নিয়েছে।
বাংলাদেশের নাগরিকদের স্বাস্থ্যের অবস্থা উন্নয়নে যুক্তরাষ্ট্র অন্যতম প্রধান অংশীদার হিসেবে রয়েছে। প্রদর্শনীতে এক আমেরিকান ডাক্তারের একটি দুর্লভ ছবি প্রদর্শিত হয়েছে। ছবিতে তিনি ১৯৬৮ সালে ঢাকার কলেরা রিসার্চ সেন্টার পরিদর্শনরত এক দর্শনার্থীর সাথে আছেন। কলেরা নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূলের লক্ষ্যে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার তিনটি গবেষণাগারের অন্যতম এই প্রতিষ্ঠানটি ইউএসএআইডি’র আরেকটি প্রয়াস। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ হিসাবে পুনঃনামকরণকৃত এবং সাধারণভাবে ও সহজ উচ্চারণে আইসিডিডিআর’বি নামে পরিচিত এ প্রতিষ্ঠানটি এখন এ অঞ্চলের অন্যতম সেরা স্বাস্থ্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান হিসাবে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত।
কোভিড-১৯ মহামারী মোকাবেলায় ইউএসএআইডি ৫০,০০০-এরও বেশি স্বাস্থ্যসেবা কর্মীকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে এবং বাংলাদেশের জনগণকে এই মহামারী থেকে সুরক্ষা দিতে এ সংক্রান্ত সহায়তা হিসেবে প্রায় ১৫ কোটি ডলার প্রদান করেছে। আমার মনে আছে, যুক্তরাষ্ট্রের অনুদানে প্রাপ্ত বহু টিকা চালানের একটির বিতরণ উপলক্ষে মেয়র ড. সেলিনা হায়াৎ আইভীর সাথে আমি নারায়ণগঞ্জ কালেক্টরেট প্রিপারেটরি স্কুল পরিদর্শনে গিয়েছিলাম। মহামারী শুরু হওয়ার পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে কোভিড-১৯’র সাড়ে ১১ কোটিরও বেশি টিকা বিনামূল্যে অনুদান দিয়েছে যা আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকে বাংলাদেশের পাওয়া করোনাভাইরাসের টিকা অনুদানের ৭০ শতাংশেরও বেশি।
স্বাধীনতার পর থেকে সক্রিয় ইউএসএআইডি বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম ও সবচেয়ে সফল উন্নয়ন সহায়তা কার্যক্রম হিসেবে রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের ঔদার্য ও বিনিয়োগ এখানে মানুষের জীবন বাঁচিয়েছে – হোক সেটা দেশের স্বাধীনতার পর খাদ্য সহায়তা অথবা দুর্যোগ মোকাবেলায় ঝুঁকি-সহিষ্ণুতা জোরদারকরণ ও স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নতকরণের সাম্প্রতিক প্রচেষ্টা যাতে সারাদেশের পরিবারগুলো দীর্ঘ ও স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন করতে পারে। গণতান্ত্রিক মূলনীতির প্রচার, সুশীল সমাজ শক্তিশালীকরণ এবং স্থানীয় সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোকে তাদের নির্বাচনী এলাকায় আরো কার্যকর সেবাদানে সহায়তা করার জন্যও যুক্তরাষ্ট্র বিনিয়োগ করে থাকে।
খুলনার স্থানীয় জেলেদের সাথে আলাপ-আলোচনাকালে তোলা আমাদের বর্তমান কৃষি অ্যাটাশে মেগান ফ্রান্সিকের একটি ছবি দেখে পেয়ে আমি অত্যন্ত আনন্দিত। এই ছবিগুলো কূটনীতি, উন্নয়ন ও মানবিক সহায়তা এবং মানুষে-মানুষে সম্পর্কসহ পুরো সময় জুড়ে দু’দেশের মধ্যেকার বন্ধন কীভাবে জোরদার হয়েছে তারই প্রমাণ।
আপনি মুগ্ধ হবেন ১৯৭৪ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের যুক্তরাষ্ট্র সফরের ঐতিহাসিক ছবি দেখে। এটাই ছিলো যুক্তরাষ্ট্রের কোনো প্রেসিডেন্টের সাথে বাংলাদেশের কোনো রাষ্ট্রপ্রধানের প্রথম সাক্ষাৎ।
বিয়াল্লিশ বছর পর ০৫ মে ২০১২, বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি রডহ্যাম ক্লিনটনের সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের মধ্যে সম্পর্ক গভীর করতে যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ অংশীদারিত্ব সংলাপে স্বাক্ষর করেন।
এ প্রদর্শনীতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিত্বকারী পূর্ববর্তী অন্যান্য বাংলাদেশী রাষ্ট্রপ্রধানদের যুক্তরাষ্ট্র সফরকালীন বিভিন্ন ঐতিহাসিক ছবিও প্রদর্শিত হয়েছে। এই ছবিগুলোতে সুশাসন, বিভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রতি সম্মান ও কার্যকরী গণতন্ত্রের অন্যতম স্তম্ভ হিসাবে মত প্রকাশের স্বাধীনতার প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গীকারের বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছে।
ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশ দীর্ঘস্থায়ী অংশীদারিত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের বহু কোম্পানি ১৯৭১ সালের আগে থেকেই বাংলাদেশে কাজ করছে। ওয়াশিংটন, ডিসিতে ২০১৩ সালে তোলা গুরুত্বপূর্ণ একটি ছবিতে যুক্তরাষ্ট্রের ভারপ্রাপ্ত ডেপুটি ট্রেড রিপ্রেজেন্টেটিভ ওয়েন্ডি কাটলার ও বাংলাদেশের বাণিজ্য সচিব মাহবুব আহমেদকে ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট কো-অপারেশন ফোরাম চুক্তি (টিকফা) স্বাক্ষর করতে দেখা যাচ্ছে। অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়নে ব্যাপক মাত্রা অর্জনের লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্র টিকফা’র মাধ্যমে বাংলাদেশের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫১তম বার্ষিকী উপলক্ষে সেক্রেটারি ব্লিঙ্কেন বলেন, “আমাদের উভয় দেশেরই অভ্যুদয় ঘটেছে স্বাধীনতার জন্য সর্বাত্মক যুদ্ধের মাধ্যমে এবং আমরা উভয় দেশই আমাদের প্রতিষ্ঠাকালীন গণতান্ত্রিক আদর্শ নিয়েই বেঁচে থাকার চেষ্টা করি। গত পাঁচ দশক ধরে আমাদের অব্যাহত সহযোগিতা বর্তমান ও আগামী প্রজন্মের জন্য একটি নিরাপদ ও আরো সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করছে।”
আজ ৫০ বছরেরও বেশি সময়ের বন্ধুত্বের স্মারক এই ঐতিহাসিক আলোকচিত্র প্রদর্শনীর উদ্বোধনকালে আমি সুশাসন ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশকে সহায়তা দেয়ার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করছি।
এ ধরনের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রদর্শনী আয়োজনে অমূল্য সহায়তার জন্য মেরিডিয়ান ইন্টারন্যাশনাল সেন্টারকে আমি ধন্যবাদ জানাই। আমি আমাদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে শক্তিশালী করতে এই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে আমাদের বিভিন্ন বিনিময় কার্যক্রমের প্রাক্তন শিক্ষার্থী ও অংশীদারদের কার্যকর ভূমিকার প্রশংসা করি।
আমি টেড কেনেডি জুনিয়রের এক জ্ঞানগর্ভ উক্তির মাধ্যমে আমার বক্তব্যের ইতি টানতে চাই, “বন্ধুত্বের চেতনা ও বটবৃক্ষের মতো শক্তিশালী ও বিস্তৃত বন্ধন বজায় রাখা আমাদের যৌথ দায়িত্ব।”
ধন্যবাদ।