মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন বিষয়ক জাতীয় কর্মপরিকল্পনা ২০১৮-২০২২ সংশোধন ও সম্প্রসারণের লক্ষ্যে আয়োজিত জাতীয় কর্মশালায় চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স হেলেন লাফাভ-এর বক্তৃতা
জানুয়ারি ১৮, ২০২৩
- মোঃ আমিনুল ইসলাম খান; স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব;
- বাংলাদেশ সরকারেরউচ্চপদস্থ ও বিশিষ্টপ্রতিনিধিবৃন্দ;
- সম্মানিত অংশীদারগণ, আমন্ত্রিত অতিথিবৃন্দ, মিডিয়ার প্রতিনিধিবৃন্দ এবং উপস্থিত ভদ্রমহিলা ও ভদ্রমহোদয়গণ:
আসসালামু আলাইকুম, নমস্কার ও শুভ সকাল!
আমি আজ আপনাদের মাঝে উপস্থিত হতে পেরে আনন্দিত এবং আমি মানব পাচারের বিরুদ্ধে লড়াই করার ব্যাপারে আপনাদের অবিচল অঙ্গীকারের জন্য আপনাদেরকে অনেক ধন্যবাদ জানাই। তাছাড়া এটি আমাদের জন্য শুভ সময় কারণ জানুয়ারি মাস হলো “মানব পাচার সচেতনতা মাস।” ২০১০ সালে তত্কালীন প্রেসিডেন্ট ওবামা জানুয়ারি মাস-কে “জাতীয় দাসত্ব ও মানব পাচার প্রতিরোধ মাস (ন্যাশনাল স্লেভারি অ্যান্ড হিউম্যান ট্রাফিকিং প্রিভেনশন মান্থ)” হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন এবং তখন থেকে আমেরিকার প্রত্যেক প্রেসিডেন্ট এই ঐতিহ্যকে পালন করে আসছে।
তাই আমরা আজো মানব পাচার প্রতিরোধে বাংলাদেশের প্রচেষ্টাকে অব্যাহতভাবে সহায়তা করে আসছি। এই অপরাধের অবসানে দৃঢ় অঙ্গীকার বজায় রাখার জন্য, আমি বিশেষ করে জনাব মোঃ আমিনুল ইসলাম খান এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে আমাদের সম্মানিত সহকর্মী ও বাংলাদেশ সরকারের সম্মানিত অন্যান্য সকল সহযোগীদের কাজের স্বীকৃতি ও কৃতজ্ঞতা জানাই।
আমরা সবাই জানি যে মানব পাচার বিশ্বব্যাপী একটি মানবাধিকার সমস্যা। প্রতিবছর বিশ্বে প্রায় ২৫ মিলিয়ন বা আড়াই কোটি নারী, পুরুষ ও শিশু পাচারের শিকার হয় যাদেরকে বাণিজ্যিকভাবে যৌনকাজে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে, বলপূর্বক শ্রম ও ঋণ-দাসত্ব হিসেবে কেনা-বেচা করা হয়। পাচারকারীরা বিশ্বের প্রতিটি দেশে মানুষকে তাদের শিকারে পরিণত করার মাধ্যমে শত হাজার কোটি টাকা (বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার) মুনাফা করে থাকে।
মানব পাচারের বিরুদ্ধে লড়াই করা যুক্তরাষ্ট্র সরকারের অন্যতম শীর্ষ অগ্রাধিকার এবং এই অপরাধ প্রতিরোধে আমরা বাংলাদেশ সরকারের সাথে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে কাজ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
আজকের জাতীয় কর্মশালা এবং এর আগে আঞ্চলিক পর্যায়ে খুলনা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও সিলেটে অনুষ্ঠিত চারটি কর্মশালা আমাদেরকে এই বার্তাই দেয় যে বাংলাদেশ মানব পাচার প্রতিরোধে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে কাজ করছে। আমি অত্যন্ত আনন্দিত যে আজকের কর্মশালায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ও এনজিও সংস্থাগুলোর প্রতিনিধিসহ অনেকেই অংশগ্রহণ করেছেন। আপনাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া এই গুরুত্বপূর্ণ কাজ ও অব্যাহত অগ্রগতি সম্ভব নয়।
আমাদের সমাজের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তিদের লক্ষ্য করে মানব পাচারের ঘটনা ঘটে। ২০২১ সালের এপ্রিল থেকে ২০২২ সালের মার্চ পর্যন্ত সময়কালে বাংলাদেশে ৫৮০টি যৌন পাচারের এবং ৬,৩৭৮টি শ্রম পাচারের ঘটনা ঘটেছে। পাচারের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে নারী, পুরুষ, এমনকি শিশুরা পর্যন্ত রয়েছে।
এই অপরাধ ব্যক্তি, সম্প্রদায় ও দেশের যে ক্ষতিসাধন করে তা ব্যাপক, আর সে কারণে পাচার প্রতিরোধে আমাদের কার্যক্রমও সেই রকম শক্তিশালী হওয়া দরকার।
আমাদের অবশ্যই মানব পাচারের শিকার হওয়া থেকে রক্ষা পাওয়া ভুক্তভোগীদের (সারভাইভর) আরো উন্নতমানের সেবা দিতে ও তাদেরকে সমাজে ফিরে গিয়ে পুনঃএকত্রীকরণে (পুনর্বাসনে) সহায়তা করতে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সারভাইভর-কেন্দ্রিক কর্মকান্ডকে অগ্রাধিকার দেওয়া অব্যাহত রাখার পাশাপাশি এই ধরনের সেবাকার্যক্রমের আরো বেশি সম্প্রসারণ করতে হবে।
মানব পাচার প্রতিরোধে বাংলাদেশের অঙ্গীকারের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট ২০২০ সাল থেকে তাদের মানব পাচার বিষয়ক ট্রাফিকিং ইন পারসনস প্রতিবেদনে বাংলাদেশকে টিয়ার ২ বা দ্বিতীয় স্তরে রেখেছে। তখন থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ মানব পাচার বিষয়ক বিচার কার্যক্রম পরিচালনার জন্য সাতটি বিশেষ ট্রাইবুনাল স্থাপন করেছে, এর মধ্যে চারটি ট্রাইবুনালে টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে, কক্সবাজারে একটি নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ ট্রাইবুনাল স্থাপন করা হয়েছে এবং বাংলাদেশ মানবপাচার রোধে প্রণীত জাতীয় কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নে যে অঙ্গীকারাবদ্ধ তা করে দেখিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র গর্বিত যে বাংলাদেশের মানবপাচার প্রতিরোধ কার্যক্রমের জাতীয় কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নে যুক্তরাষ্ট্র ইউএসএআইডি-র “ফাইট স্লেভারি অ্যান্ড ট্রাফিকিং ইন পারসনস” প্রকল্পের মাধ্যমে সহায়তা করতে পেরেছে।
গত এক বছরে ইউএসএআইডি বিচারক, পাবলিক প্রসিকিউটর, ট্রাইবুনাল স্টাফ ও প্যানেল আইনজীবীসহ বিচার বিভাগ সংশ্লিষ্ট ৪০০ জনেরও বেশি ব্যক্তিকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে। এছাড়াও আমরা স্থানীয় পর্যায়ে ৩,০০০ এরও বেশি ব্যক্তিকে প্রশিক্ষণ দিয়েছি যাদের মধ্যে পাচার প্রতিরোধ কমিটির সদস্যরা রয়েছেন। এবং আমরা ২০০ জনেরও বেশি পাচারের শিকার হওয়া থেকে ফিরে আসতে পারা ভুক্তভোগী বা সারভাইভরকে সুরক্ষা সেবা প্রদান করেছি।
২০২২ সালের নভেম্বরে ইউএসএআইডি-র ফাইট স্লেভারি অ্যান্ড ট্রাফিকিং ইন পারসনস প্রকল্প পাচারের শিকার হওয়া তিনজন বাংলাদেশী সম্পর্কে জানতে পেরেছিল যাদেরকে কম্বোডিয়া থেকে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। তাদেরকে আশ্রয়কেন্দ্রে থাকার সহায়তা, মনোসামাজিক কাউন্সেলিং ও তাদের পরিবারের সাথে অবিলম্বে একত্রীকরণসহ সুরক্ষা সহায়তা দেওয়া হয়েছে।
এই ধরনের কাজগুলো আমরা আপনাদের সাথে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে চালিয়ে যাব যাতে করে আমরা পাচারের শিকার হয়ে ফিরে আসা আরো বেশি ভুক্তভোগীদের (সারভাইভর) প্রয়োজনীয় সহায়তাগুলো করার পাশাপাশি তাদেরকে সামগ্রিকভাবে সেবাযত্ন করতে পারি এবং স্থানীয়ভাবে ও দেশজুড়ে পাচার প্রতিরোধে আরো বেশি ভূমিকা রাখতে পারি।
এছাড়াও আমরা বুঝতে পারি যে, আমাদের আরো অনেক কিছু করার আছে। তেমনই একটি কাজ হলো পাচার প্রতিরোধে জাতীয় কর্মপরিকল্পনা জোরদার করা।
তবে, কোন পরিকল্পনাই সফল হতে পারে না যদি না সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কাজ করা না হয়। আর সেই কারণেই যুক্তরাষ্ট্র সরকার পাচার প্রতিরোধে জাতীয় কর্মপরিকল্পনা জোরদার করা ও মানবপাচারের মতো ভয়ঙ্কর অপরাধের অবসানে বাংলাদেশের প্রচেষ্টাকে অব্যাহতভাবে সহায়তা করবে। অনেক বাংলাদেশী এখনো ঝুঁকির মুখে রয়েছে এবং বিপুল সংখ্যক মানব পাচারের মামলা এখনো বিচারাধীন।
মানবপাচার প্রতিবেদনের র্যাংকিং মানব পাচার প্রতিরোধে গৃহীত কর্মকান্ড আগের বছরের তুলনায় কী পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে তার উপর নির্ভর করে, শুধু একইরকমভাবে কাজ করার উপর নয়। পাচার বন্ধের লড়াইয়ে আমরা কেউই আত্মতুষ্ট হতে পারি না। সরকার পাচার প্রতিরোধে কার্যক্রম এগিয়ে নিতে জাতীয় কর্মপরিকল্পনা বর্ধিতকরণ/সম্প্রসারণ, সেবাদানকারীদের নির্দেশিকাগুলো বাস্তবায়ন, ভিকটিম/ভুক্তভোগী শনাক্তকরণ প্রটোকল বাস্তবায়নের মতো কার্যক্রমগুলো গ্রহণ করতে পারে।
আমাদের লক্ষ্যগুলো অভিন্ন, আপনাদের লক্ষ্যগুলোর সাথে মেলানো এবং আমরা আশা করি যে আজকের কর্মশালা ও আপনাদের গুরুত্বপূর্ণ মতামত আমাদেরকে আরো শক্তিশালী ও জোরালো পরিকল্পনার দিকে এগিয়ে নেবে; যার ফলশ্রুতিতে মানব পাচার বিরোধী কার্যক্রম আরো জোরদার হবে যা ভুক্তভোগীদের সুরক্ষা দেবে; অপরাধীদের আরো কার্যকরভাবে বিচারের আওতায় আনা সম্ভব হবে ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা যাবে; এবং মানব পাচার প্রতিরোধে সরকার, এনজিও, নাগরিক সমাজ ও সকল নাগরিকের অংশীদারিত্বের শক্তিকে আরো ভালোভাবে কাজে লাগানোর জন্য সকলে মিলে আরো ঘনিষ্ঠভাবে ও ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করা সম্ভব হবে।
আমি বিশ্বাস করি যে, আমাদের সম্মিলিত কাজ ও অঙ্গীকারের মাধ্যমে আমরা মানব পাচার প্রতিরোধে ও পাচারের শিকার ভুক্তভোগীদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে পারব।
আজকের এই কর্মশালা চলমান প্রক্রিয়ার অগ্রগতির ক্ষেত্রে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ।
আপনাদের সকলকে অনেক ধন্যবাদ।