বঙ্গোপসাগর বিষয়ক সংলাপে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত হাসের বক্তব্য

“ইন্দোপ্যাসিফিক অঞ্চলের বহুপাক্ষিক কাঠামোর অপার সহযোগিতার দ্বার উন্মোচনবিষয়ক প্যানেল প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও ঢাকা, ঢাকা, বাংলাদেশ

সোমবার, ২১ নভেম্বর ২০২২

(বক্তব্য প্রদানের জন্য প্রস্তুতকৃত)

ভূমিকা

আমরা বর্তমানে এক গুরুত্বপূর্ণ দশকের শুরুর দিকে দাঁড়িয়ে আছি। এটি শুধু বঙ্গোপসাগরের জন্য নয়, বরং বৃহত্তর ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল ও বিশ্বের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ।

যে হুমকিগুলো নিয়ে আমরা সবাই উদ্বিগ্ন, সেগুলো একসাথে সমাধানের সুযোগ দ্রুত বন্ধ হয়ে আসছে।

আমরা কি আমাদের পৃথিবীকে আরেকটু ভালো রেখে যাওয়ার কথা জেনে দশকটি শেষ করবো?

আমরা কি আরো ঝুঁকি-সহিষ্ণু জনস্বাস্থ্য-ব্যবস্থা ও মহামারী মোকাবেলার কর্মপন্থা তৈরি করবো?

আমরা কি জাতিসংঘ সনদের মূলনীতি তথা সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখণ্ডতাকে সমুন্নত রাখবো ও সম্মান জানাবো?

আমরা কি খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারবো?

বিশ্ব সম্প্রদায় হিসাবে আমরা এখন একসাথে যে পদক্ষেপগুলো নেবো, সেগুলোই এই সময়টি সংঘাত ও বিরোধের যুগ হিসেবে, নাকি আরো স্থিতিশীল ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের সূচনা হিসাবে পরিচিত হবে, সেটা নির্ধারণ করবে।

সেই ভবিষ্যতের অনেকটাই লেখা হবে এই ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপকূলরেখা থেকে ভারত মহাসাগর পর্যন্ত প্রসারিত ইন্দো-প্যাসিফিক বিশ্বের সবচেয়ে গতিশীল অঞ্চল। অঞ্চলটি বিশ্বের অর্ধেকেরও বেশি মানুষের আবাসভূমি এবং পুরো বিশ্বের অর্থনীতির প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ। এখানে যা কিছু ঘটে তা সমগ্র বিশ্বেই প্রভাব ফেলে।

আজ আমি এ অঞ্চলকে ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের রূপকল্প তুলে ধরতে চাই, এবং এর বাস্তবায়নে আমরা যে দুটি চ্যালেঞ্জ দেখতে পাই সেগুলো নিয়ে বলবো: স্বৈরাচার থেকে প্রতিযোগিতা বেড়ে যাওয়া এবং জলবায়ু পরিবর্তনের মতো ক্রমবর্ধমান আন্তঃদেশীয় হুমকি।

একটি সম্মিলিত রূপকল্প

আমাদের লক্ষ্য সম্মিলিত। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০২১ সালের প্যারিস শান্তি ফোরামে এই অঞ্চলের জন্য বাংলাদেশের রূপকল্প বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন:

ইন্দোপ্যাসিফিক অঞ্চলটিকে অবশ্যই সবার জন্য শান্তিপূর্ণ সমৃদ্ধ এলাকা হতে হবে।
এই অঞ্চলের জন্য আমাদের রূপকল্প হল অবাধ, উন্মুক্ত, শান্তিপূর্ণ, নিরাপদ
অন্তর্ভুক্তিমূলক অঞ্চল।

এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র আন্তরিকভাবে একমত। বাংলাদেশ ও অন্যান্য অংশীদারদের সাথে নিয়ে আমরা ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলকে এমনভাবে গড়ে তোলার জন্য কাজ করতে চাই যার বৈশিষ্ট্য থাকবে পাঁচটি। আমরা এমন একটি অঞ্চল চাই যা হবে:

১। অবাধ ও উন্মুক্ত

২। আন্তঃসংযুক্ত

৩। সমৃদ্ধশালী

৪। নিরাপদ, এবং

৫। কষ্ট-সহিষ্ণু।

অন্যান্য অনেক দেশের সাথে যৌথভাবে আমরা এই রূপকল্পটি গ্রহণ করেছি।

আমরা প্রত্যেকে একে আলাদা নামে ডাকতে পারি— কৌশল, রূপকল্প, লক্ষ্য বা দৃষ্টিভঙ্গি— তবে সেখানে অবিশ্বাস্যরকম মিল রয়েছে। এটি আমাদের সম্মিলিত শক্তির অংশ। আমাদেরকে এমন সব ক্ষেত্র খুঁজে বের করতে হবে যেখানে আমাদের সবার দৃষ্টিভঙ্গি এক হয়েছে এবং সেসব লক্ষ্যকে একসাথে এগিয়ে নিতে অংশীদারিত্ব স্থাপন করতে হবে।

আমি শুরুতেই এটা বলতে চাই, কোনো দেশকে জোর করে কোনো পক্ষ বেছে নিতে বাধ্য করাটা আমাদের কৌশল নয়। বরং আমরা এ অঞ্চলের অবাধ ও উন্মুক্ত থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করতে চাই যেন এখানকার দেশগুলো স্বাধীনভাবে তাদের নিজেদের সিদ্ধান্ত নিজেরা নিতে পারে।

এবার আমি একে একে যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গির পাঁচটি মূল উপাদান নিয়ে কথা বলবো।

প্রথমত, আমরা একটি অবাধ উন্মুক্ত ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল গঠনের বিষয়টিকে এগিয়ে নেবো, যেখানে স্বচ্ছতা, সুশাসনের মাধ্যমে জনগণের প্রতি সংবেদনশীলতা নিশ্চিত করবে এবং এ ব্যবস্থায় মালামাল, ধারণা ও মানুষ যেন সাইবারস্পেস ও উন্মুক্ত সমুদ্রে স্বাধীনভাবে চলাচল করতে পারবে।

এ কাজে বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশ তাদের স্থল ও সমুদ্র-সীমান্ত বিরোধের শান্তিপূর্ণ সমাধানে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়ে বঙ্গোপসাগরকে বিশ্বের কাছে অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত করে তুলেছে।

স্বচ্ছ ও সংবেদনশীল শাসন বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র সার্বজনীন মানবাধিকারের প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখবে। তাছাড়া আমরা আইনের আওতায় ন্যায়বিচার ও সমান আচরণ নিশ্চিত করার জরুরী কাজ অব্যাহত রেখেছি বিধায় আমরা স্বাধীনতা ও মর্যাদাকামীদের সাথে একাত্মতা বজায় রাখবো।

আমরা নিজ দেশে ও সারা বিশ্বে গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করার জন্য কাজ করব এবং মানবাধিকার সমুন্নত রাখতে আমরা কুণ্ঠাবোধ করবো না। আমরা এটা করি কারণ গণতান্ত্রিক শাসন কেবল মানুষের মর্যাদা সুরক্ষায় কর্তৃত্ববাদকে ক্রমাগত ছাড়িয়েই যায় না, বরং আরো সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী সমাজের দিকে পরিচালিত করে।

দ্বিতীয় উপাদান হলো, যুক্তরাষ্ট্র এই অঞ্চলের অভ্যন্তরে এবং এর বাইরেও শক্তিশালী সংযোগ স্থাপন অব্যাহত রাখবে। যৌথ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আমাদেরকে অবশ্যই আঞ্চলিক পর্যায়ে ঐক্যবদ্ধ জনগোষ্ঠী হিসাবে কাজ করতে হবে। এর অর্থ হলো, পুরানো অংশীদারিত্বকে শক্তিশালী করা এবং নতুন অংশীদারিত্ব স্থাপন করা।

আমাদের ঘনিষ্ঠ অংশীদার অস্ট্রেলিয়া, জাপান ও যুক্তরাজ্যের বন্ধুদের সাথে এক মঞ্চে বসতে পেরে আমি গর্বিত। আমাদের প্রত্যেকেরই নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি আছে। আমাদের নিজস্ব শক্তি আছে। তাছাড়া আমাদের নিজেদের জাতীয় স্বার্থ আছে। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি আমাদের সকলেরই ভবিষ্যতের জন্য একটি সম্মিলিত রূপকল্প ও দৃঢ় বিশ্বাস আছে যে, সেই রূপকল্প বাস্তবায়নে আমাদেরকে অবশ্যই সব জাতির সঙ্গে একসাথে কাজ করতে হবে।

এ বিষয়ে আমি ইন্ডিয়ান ওশান রিম অ্যাসোসিয়েশনের সভায় সভাপতিত্ব করার জন্য বাংলাদেশকে ধন্যবাদ জানাতে চাই যেটিা এ সপ্তাহের শেষ দিকে অনুষ্ঠিত হবে।

তৃতীয়ত, যুক্তরাষ্ট্র ব্যাপকভিত্তিক সমৃদ্ধিকে উৎসাহিত করবে, যাতে এই একবিংশ শতাব্দীতে কেউ পিছিয়ে না থাকে।

যুক্তরাষ্ট্র ও ১৩টি অংশীদার দেশ এক অভিনব অর্থনৈতিক ব্যবস্থা তথা ইন্দো-প্যাসিফিক ইকোনমিক ফ্রেমওয়ার্ক বা আইপিইএফ-এর জন্য সমঝোতা শুরু করেছে যেখানে বাণিজ্য ও বিনিয়োগের বাইরেও ২১ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আমাদের সম্মিলিত ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটবে।

আইপিইএফ-এর সদস্যপদের মাধ্যমে এ অঞ্চলে অর্থনৈতিক বৈচিত্র্যের পাশাপাশি অংশীদার দেশগুলোর মধ্যে আন্তঃসংযোগের প্রতিফলন ঘটবে যা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও উদ্ভাবনকে ত্বরান্বিত করবে।

আইপিইএফ-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রেসিডেন্ট বাইডেন যেমনটি বলেছিলেন, এর উদ্দেশ্য হলো অন্যদের জন্য উন্মুক্ত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক হওয়া। আইপিইএফ-এর লক্ষ্যগুলো গ্রহণ এবং সেই লক্ষ্য অর্জনে কাজ করা সাপেক্ষে ভবিষ্যতে অন্যরাও এতে যোগ দিতে পারবে।

আমরা এ বিষয়গুলো নিয়ে কাজ অব্যাহত রাখবো এবং বাংলাদেশসহ সব দেশের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিকভাবে আমাদের অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব বৃদ্ধি করবো।

চতুর্থত, যুক্তরাষ্ট্র ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে নিরাপত্তা জোরদার করবে।

বিগত ৭৫ বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্র এই অঞ্চলে একটি শক্তিশালী ও ধারাবাহিক প্রতিরক্ষা উপস্থিতি বজায় রেখে আসছে এবং এ অঞ্চলে স্থিতিশীলতা ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা অব্যাহত রাখবে।

সহিংস চরমপন্থা থেকে শুরু করে অবৈধ মাছ শিকার ও মানব পাচারসহ বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আমরা অংশীদারদের সাথে নিবিড় নিরাপত্তা সহযোগিতা স্থাপনের প্রচেষ্টা নেবো।

এসব চ্যালেঞ্জ ও আরো বহু বিষয়ে বাংলাদেশের সাথে অংশীদারিত্ব স্থাপন করতে পেরে যুক্তরাষ্ট্র গর্বিত। উদাহরণস্বরূপ, গত সেপ্টেম্বর মাসে আমরা যৌথভাবে ইন্দো-প্যাসিফিক আর্মিস ম্যানেজমেন্ট সেমিনার আয়োজন করেছি, যেখানে ২৪টি দেশ এখানে ঢাকায় একত্রিত হয়ে নিজেদের ধারণা আদান-প্রদান, সম্পর্ক তৈরি এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে বিভিন্ন নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে খোলাখুলি কথা বলেছে।

এ অঞ্চলের স্থিতিশীলতার প্রশ্নে একটি বড় নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ হলো বার্মায় নৃশংস সামরিক অভ্যুত্থান এবং রোহিঙ্গাদের ওপর পরিচালিত গণহত্যা। বার্মার সামরিক শাসকেরা তার নিজেদের জনগণের ওপর যে নৃশংসতা ও সহিংসতা চালিয়ে যাচ্ছে সেটা শেষ হওয়ার কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। উপরন্তু, কিছু দেশ বার্মার সামরিক শাসকদেরকে প্রাণঘাতী অস্ত্রসামগ্রী দিয়ে সহায়তা করে চলেছে এবং এর ফলে সহিংসতা ও নিপীড়ন আরো প্রকট হয়ে উঠছে।

এ কারণে গত ৮ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অফ ট্রেজারি বার্মার সামরিক বাহিনীর কাছে সামরিক বিমানের যন্ত্রাংশ সরবরাহকারী অন্যতম প্রধান প্রতিষ্ঠানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। আমরা অবিলম্বে বার্মার কাছে অস্ত্র, সামরিক সরঞ্জাম, দ্বৈত-ব্যবহারযোগ্য সরঞ্জাম এবং প্রযুক্তিগত সহায়তা বিক্রয় বা হস্তান্তর বন্ধের জন্য সমস্ত দেশের কাছে অনুরোধ রাখছি। তাছাড়া নিষেধাজ্ঞা ও আন্তর্জাতিক চাপের মাধ্যমে বার্মাকে জবাবদিহি করতে যুক্তরাষ্ট্র মিত্রদেশ ও অংশীদারদের সাথে কাজ অব্যাহত রাখবে।

গুরুত্বপূর্ণ এ অঞ্চলের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলের পঞ্চম উপাদান হল আন্তর্জাতিক পর্যায়ে হুমকির বিপরীতে আঞ্চলিক ঝুঁকিসহিষ্ণুতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করা।

আন্তর্জাতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্র অংশীদারদের ঝুঁকি-সহিষ্ণুতা বৃদ্ধির জন্য কাজ করবে। এই চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে রয়েছে জলবায়ু ও জীবতাত্ত্বিক হুমকি। আমরা সবাই জানি, ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল হলো জলবায়ু সংকটের কেন্দ্রবিন্দু এবং জলবায়ু বিষয়ক সমাধানের প্রশ্নে এ অঞ্চলটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জলবায়ু সংকট নিরসনে আমাদের সম্মিলিত পদক্ষেপ গ্রহণ শুধু একটি রাজনৈতিক আবশ্যকতা নয়, এটি একটি অর্থনৈতিক সুযোগও বটে।

আমরা যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক কার্যক্রম বাস্তবায়ন ও পরিবেশ সুরক্ষা বিষয়ে সহায়তার প্রস্তাব দিয়েছি। এই সহায়তা জীববৈচিত্র্য ও বাস্তুতন্ত্র সংরক্ষণকে উৎসাহিত করে এবং বাংলাদেশের দুটি প্রধান জীববৈচিত্র্যপূর্ণ এলাকায় পরিবেশগত সুশাসন ও ব্যবস্থাপনাকে শক্তিশালী করে: দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্য স্থান হিসেবে স্বীকৃত সংরক্ষিত বনাঞ্চল সুন্দরবন এবং যথাক্রমে দক্ষিণ-পূর্ব ও উত্তর-পূর্বে অবস্থিত পরিবেশগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ বন ও জলাভূমি। বিগত ২০ বছরে আমাদের সহায়তার আওতায় বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদ ও জীববৈচিত্র্য সুরক্ষায় স্থানীয় জনসমাজ ও সরকারকে একত্র করে ১০ লাখ হেক্টরেরও বেশি ভূমি সহ-ব্যবস্থাপনার আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে। ফলে বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি-সহিষ্ণুতা আরো জোরদার হয়েছে।

প্যারিস চুক্তির আওতায় আমরা বাংলাদেশ ও বৃহত্তর বঙ্গোপসাগর অঞ্চলের জন্য জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক প্রতিশ্রুতি অর্জন এবং জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজন ও প্রশমন কৌশল বাস্তবায়নে অংশীদারিত্ব স্থাপনের অন্যান্য সুযোগকে স্বাগত জানাই।

এ অঞ্চলটিতে মহামারী সৃষ্টিকারী রোগ প্রতিরোধের সক্ষমতা তৈরি এবং এখানকার স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে আরো শক্তিশালী করতেও আমরা অংশীদারিত্ব স্থাপন করছি। যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক বাংলাদেশে ১০ কোটিরও বেশি টিকা প্রদানের মাইলফলক উদযাপনের অংশ হিসেবে আমি সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জ সফর করেছি। এই মাইলফলকটি আমাদের দুই দেশের মধ্যেকার শক্তিশালী অংশীদারিত্বেরই প্রকাশ এবং সমগ্র জনসংখ্যার প্রায় ৭৫ শতাংশকে সম্পূর্ণ টিকার আওতায় আনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবিশ্বাস্য অগ্রগতির একটি অংশ মাত্র।

চ্যালেঞ্জসমূহ

একটি উন্মুক্ত, আন্তঃসংযুক্ত, সমৃদ্ধ, নিরাপদ ও ঝুঁকি-সহিষ্ণু ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠায় আমাদের যে লক্ষ্য সেটি হুমকির মুখে। আমরা দুটি বৃহত্তর চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি।

আমাদের লক্ষ্যটি সবচেয়ে বড় যে কৌশলগত চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি সেটি হলো কর্তৃত্ববাদী শক্তিগুলো আন্তর্জাতিক সম্পর্কের পথে মূলনীতিগুলোর ব্যত্যয় ঘটানোর চেষ্টা করছে।

উদাহরণস্বরূপ, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের একটি স্থায়ী সদস্যদেশ তাদের প্রতিবেশী দেশে আক্রমণ করে একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রকে মানচিত্র থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা করছে। ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার নৃশংস যুদ্ধের সুদূরপ্রসারী পরিণতি দেখা যাচ্ছে। এর ফলে বৈশ্বিক অর্থনীতি, খাদ্য নিরাপত্তা ও জ্বালানি বাজারের ওপর সৃষ্ট চাপ মোকাবেলায় আমরা মিত্রদেশ ও অংশীদারদের সাথে কাজ অব্যাহত রাখবো।

পুতিন যুদ্ধ বন্ধ করলে অশান্তি শেষ হতে পারে। আর ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ করলে ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব শেষ হয়ে যাবে।

আমি চীন সম্পর্কে খোলাখুলি কথা বলবো । গত সপ্তাহে প্রেসিডেন্ট বাইডেন প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংকে স্পষ্টভাবে বলেছেন যে, যুক্তরাষ্ট্র সংঘাত চায় না বরং দায়িত্বশীলতার সাথে প্রতিযোগিতা সামাল দিতে চায়। তাঁরা বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করেছেন। প্রেসিডেন্ট বাইডেন সেক্রেটারি ব্লিঙ্কেনকে সেই আলোচনা চালিয়ে যেতে এবং যোগাযোগের সুযোগ অবারিত রাখতে চীন সফর করতে বলেছেন।

চীনই একমাত্র দেশ যাদের একইসাথে অভিপ্রায় রয়েছে আন্তর্জাতিক শৃঙ্খলা পুনর্গঠনের এবং সেই লক্ষ্যে তারা ক্রমবর্ধমানভাবে অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক, সামরিক ও প্রযুক্তিগত শক্তি অর্জন করছে।

বৈশ্বিক অর্থনীতি থেকে শুরু করে জলবায়ু ও কোভিড-১৯ পর্যন্ত বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ নিরসনে আমাদের সক্ষমতা অর্জনের ক্ষেত্রেও চীন অত্যাবশ্যক। সহজ কথায়, অদূর ভবিষ্যতের জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও চীনকে একে অপরের সাথে সহযোগিতা করতে হবে।

গত সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের বক্তৃতা উদ্ধৃত করে আমি যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যেকার প্রতিযোগিতা সম্পর্কে সরাসরি বলতে চাই:

আমরা পরিবর্তনশীল ভূরাজনৈতিক প্রবণতা মোকাবেলা করছি বিধায় যুক্তরাষ্ট্র
যৌক্তিকভাবেই তাদের নেতৃত্ব বজায় রেখে চলবে। আমরা সংঘর্ষ চাই না। আমরা শীতল
যুদ্ধ চাই না। আমরা কোনো দেশকে যুক্তরাষ্ট্র অথবা অন্য কোনো দেশকে বেছে নিতে
বলছি না।

তবে একটি অবাধ, উন্মুক্ত, নিরাপদ সমৃদ্ধ বিশ্ব গঠনে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি উৎসাহিত
করতে এবং বিভিন্ন জনগোষ্ঠী দেশকে যেসব সহায়তা দিতে যুক্তরাষ্ট্র কুণ্ঠাবোধ করবে
না সেগুলো হলো:

নির্ভরতা বাড়ানোর জন্য নয় বরং বোঝা কমানোর জন্য এবং বিভিন্ন দেশকে স্বয়ংসম্পূর্ণ
হতে সহায়তার লক্ষ্যে পরিকল্পিত বিনিয়োগ [এবং

অংশীদারিত্ব স্থাপন করারাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা তৈরির জন্য নয়, বরং এজন্য যে,
আমরা জানি আমাদের নিজেদের সাফল্য তথা আমাদের প্রতিটি সাফল্য আরো জোরদার
হয় যখন অন্যান্য দেশও সফল হয় 

যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতি অংশীদারিত্ব ও পারস্পরিক স্বার্থের প্রতি শ্রদ্ধার ভিত্তিতে পরিচালিত।

আমরা আশা করি না যে, প্রতিটি দেশ চীনকে আমাদের মতো করেই মূল্যায়ন করবে।

আমরা জানি যে, যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশই চীনের সাথে তাদের অত্যাবশ্যক অর্থনৈতিক সম্পর্ক বা দুদেশের মানুষের মধ্যেকার বন্ধন বজায় রাখতে চায়।

স্পষ্ট করে বলতে চাই। এটা এমন নয় যে, দেশগুলোকে কোন পক্ষ বেছে নিতে বাধ্য করা হচ্ছে । বরং সবাইকে বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা দেয়াটাই মূল লক্ষ্য।

এই দৃষ্টিভঙ্গির দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জটি হলো এই যে, এই প্রতিযোগিতা চলাকালে সারা বিশ্বের মানুষকে আন্তঃসীমান্ত পর্যায়ে বিভিন্ন সাধারণ সমস্যা তথা জলবায়ু পরিবর্তন, খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা, সংক্রামক রোগ বা মুদ্রাস্ফীতির প্রভাব নিরসনের মতো বিষয়ে লড়াই করতে হচ্ছে।

এই সম্মিলিত চ্যালেঞ্জ ভূ-রাজনীতির জন্য গৌণ বিষয় নয়। এগুলো জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার একেবারে কেন্দ্রে অবস্থিত এবং এগুলোতে অবশ্যই যথাযথ গুরুত্ব দিতে হবে। এসব চ্যালেঞ্জের প্রকৃতি অনুযায়ী এগুলোর সমাধানে বিভিন্ন দেশের সরকারের মধ্যে সহযোগিতা আবশ্যক হবে।

খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার বৃহত্তর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় যুক্তরাষ্ট্র একটি আহ্বান তথা বিশ্বব্যাপী খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা দূরীকরণের একটি রোডম্যাপ করেছে যেখানে ইতোমধ্যেই ১০০টিরও বেশি সদস্যদেশ সমর্থন জানিয়েছে।

তাছাড়া ইউএসএআইডি’র ফিড দ্য ফিউচার শীর্ষক উদ্যোগের আওতায় যুক্তরাষ্ট্র সারা বিশ্বে ও এখানে বাংলাদেশে কৃষকদের প্রয়োজন অনুযায়ী তাদের হাতে খরা ও তাপ সহনশীল বীজ পৌঁছে দেয়ার বিভিন্ন উদ্ভাবনী পন্থা সম্প্রসারণ করছে। কৃষকেরা সার পাচ্ছেন এবং সারের কার্যকারিতা বাড়ানো হচ্ছে যাতে তারা কম সার ব্যবহার করেও বেশি খাদ্য ফলাতে পারে।

নিম্ন আয়ের দেশগুলোকে তাদের জলবায়ু বিষয়ক লক্ষ্য বাস্তবায়নে সহায়তা দিতে এবং একটি দূষণহীন জ্বালানি ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে যুক্তরাষ্ট্র আন্তর্জাতিক জলবায়ু অর্থায়নে তহবিল সরবরাহে কাজ করার মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় বিশ্বব্যাপী দায়িত্ব পালনে অঙ্গীকারবদ্ধ।

এই প্রচেষ্টার অন্যতম প্রধান অংশ হল অভিযোজন ও ঝুঁকি-সহিষ্ণুতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে গৃহীত প্রেসিডেন্টের জরুরী পরিকল্পনা যা PREPARE (পরিকল্পনা) নামেও পরিচিত। কপ২৭-এ প্রেসিডেন্ট বাইডেন কর্তৃক সূচিত সম্পূর্ণ সরকারি এই উদ্যোগটি ৫০ কোটি মানুষকে ও বিশেষত নাজুক দেশগুলোকে জলবায়ু পরিবর্তনের বিভিন্ন প্রভাবের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে এবং ঝুঁকি-সহিষ্ণুতা বৃদ্ধি করতে সহায়তা করবে।

জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বৈশ্বিক ও আন্তর্জাতিক সমস্যা নিরসনে যুক্তরাষ্ট্র আমাদের প্রতিযোগী দেশসহ প্রতিটি দেশের সাথেই কাজ করতে প্রস্তুত।

উপসংহার:

পরিশেষে, আমরা এসব চ্যালেঞ্জের কোনটিকেই উপেক্ষা করতে পারি না। গত সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে প্রেসিডেন্ট বাইডেন তাঁর বক্তৃতায় আমাদের সম্মিলিত সাধারণ ভিত্তি এবং সমস্ত দেশের সাথে সহযোগিতা চেয়ে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছেন:

ভয় জবরদস্তিমূলক বৈশ্বিক রাজনীতির বিরুদ্ধে দাঁড়ানো; এবং 

ছোট দেশগুলোর জন্যও বড় দেশগুলোর সমান সার্বভৌম অধিকারের সুরক্ষা প্রদান

চলাচলের স্বাধীনতা, আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি শ্রদ্ধা এবং অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের মতো বিভিন্ন
মূলনীতি গ্রহণ করা; [এবং]

অন্য যেকোন বিষয়ে আমাদের দ্বিমত থাকুক না কেন, এসব সাধারণ ভিত্তির ওপর
আমাদের একত্রে দাঁড়াতে হবে

আমরা বর্তমানে এক গুরুত্বপূর্ণ দশকের শুরুর দিকে দাঁড়িয়ে আছি। আসুন, আমরা ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে ও সারা বিশ্বে শান্তি ও সমৃদ্ধির ভিত্তি শক্তিশালী করতে একসাথে কাজ করি। আপনাদেরকে ধন্যবাদ।