মঙ্গলবার, ৩১ মে, ২০২২
শুভ সকাল। গত সপ্তাহে বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস উদযাপন উপলক্ষ্যে সম্পাদক ও সাংবাদিকদের অন্য একটি দলের সঙ্গে আমার কথা বলার সুযোগ হয়েছিল।
আমি সেই বক্তব্য শুরু করেছিলাম একটি বার্তা দিয়ে; যে বার্তা আজ আমি আপনাদেরও পৌঁছে দিতে চাই: ধন্যবাদ। আপনাদের পেশা মহান।
এবং এটি বিশ্বজুড়ে, ক্রমেই কঠিন ও বিপজ্জনক একটি পেশা হয়ে উঠছে।
আমরা প্রতিদিন আপনাদের করা সংবাদে এর প্রমাণ দেখতে পাই, এবং আপনাদের এই সাহসকে আমি সাধুবাদ জানাই।
একটি মুক্ত সমাজে আপনাদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ; আর আমাদের সবার দায়িত্ব হলো মুক্ত সংবাদমাধ্যমকে রক্ষা করা এবং ভয়, হয়রানি বা নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই সাংবাদিকদের সত্যকে অনুসন্ধান ও রিপোর্ট করার সুযোগ দেওয়া।
আমি আপনাদের জানাতে চাই যে যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস সেই দায়িত্বকে গুরুত্বের সঙ্গে নেয় এবং এটি পূরণের জন্য সম্ভাব্য সব কিছুই করছে।
আবার বলছি, যা করছেন তার জন্য আপনাদের ধন্যবাদ।
যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত হিসেবে আমি বাংলাদেশে আছি প্রায় তিন মাস হল, এবং এখানে আসার পর এই প্রথম ওয়াশিংটন সফরে যাচ্ছি।
সেখানে থাকাকালে যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কয়েকজন সরকারি কর্মকর্তা, কংগ্রেস কর্মী, এনজিও ও ব্যবসায়ীর সঙ্গে আমার অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণ নিয়ে আলোচনা করার পরিকল্পনা আছে।
আমি তাদেরকে কী বলতে যাচ্ছি?
আসলে, ওয়াশিংটন গিয়ে আমার তিনটি বিষয় নিয়ে রিপোর্ট করার পরিকল্পনা আছে।
· প্রথমত, বাংলাদেশের সাফল্যগুলো বাস্তব।
· দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশ যেসব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয় সেগুলোও বাস্তব।
· এবং তৃতীয়ত, যুক্তরাষ্ট্রকে আগামী পঞ্চাশ বছর ধরে বাংলাদেশের সঙ্গে একই ভাবে অবিচল অংশীদার হিসেবে থাকতে হবে, যেমনটি গত পঞ্চাশ বছর ধরে রয়েছে।
বাংলাদেশের সাফল্যগুলো বাস্তব।
এক মুহূর্তের জন্য ভেবে দেখুন, স্বাধীনতা যুদ্ধের পর থেকে, একটি সদ্যোজাত দেশ থেকে — বাংলাদেশ কত দূরে এসেছে। সংঘাত বিধ্বস্ত দেশ থেকে বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির একটি সমৃদ্ধশালী দেশে পরিণত হয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের মতে, মূল্যস্ফীতি হিসেবে নিয়ে ১৯৭২ সাল থেকে বাংলাদেশের জিডিপি প্রায় ৫০ গুণ বড় হয়েছে।
সে বছর, বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি ছিল আজকের মুদ্রায় ৯৪ ডলার।
আজ, সেটি প্রায় ২০০০ ডলার। একই সময়ে, শিশুমৃত্যুর হার কমেছে ৮৫ শতাংশ।
গত ২০ বছরে, দেশটিতে জাতীয় দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করা মানুষের সংখ্যা অর্ধেকে নেমে এসেছে।
যার মানে, প্রায় চার কোটি মানুষ দারিদ্র্য থেকে উঠে এসেছে।
শীগগিরই, স্বল্পোন্নত দেশের মর্যাদা থেকে বাংলাদেশের উত্তরণ ঘটবে, এবং এটি মধ্য আয়ের দেশ হওয়ার পথে অবিচলভাবে এগিয়ে যাচ্ছে।
এই অর্জনগুলো বাস্তব, স্পষ্ট এবং সত্যিই অসাধারণ।
কিন্তু এই অর্জনগুলো যতটা বাস্তব, বাংলাদেশ এখন যেসব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে সেগুলোও ততটাই বাস্তব।
এবং সেগুলোও কম উদ্বেগের নয়।
দীর্ঘ উপকূলরেখা ও বিশাল প্লাবনভূমি সহ একটি নিচু নদীভিত্তিক ব-দ্বীপে বাংলাদেশের ভৌগলিক অবস্থানই একে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলে।
বাড়তে থাকা তাপমাত্রা ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, ফসলহানি, খাদ্য স্বল্পতা, শ্বাসযন্ত্রের রোগ ও মশা-বাহিত রোগের আশঙ্কা বাড়িয়ে তোলে ।
গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের বিষয়ে, যুক্তরাষ্ট্র আমাদের উদ্বেগের কথা তুলে ধরেছে।
সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা, বিশেষ করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এবং বেশ কিছু খসড়া আইন ও নীতিমালা নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন, যেগুলো সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব করতে পারে।
আমরা বিচারবহির্ভূত হত্যা ও গুম সহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো নিয়ে উদ্বিগ্ন।
আমি নিশ্চিত আপনারা জানেন, গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের নির্ভরযোগ্য প্রমাণের ভিত্তিতে, ২০২১ সালের ১০ ডিসেম্বর, মানবাধিকার দিবসে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন এবং এর কিছু কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র।
বাংলাদেশে অপর্যাপ্ত শ্রম অধিকার এবং কর্মপরিবেশের নিম্নমান নিয়েও আমরা উদ্বিগ্ন।
দুর্ভাগ্যবশত, ২০১৩ সালে ইউ.এস. জেনারালাইজড সিস্টেম অব প্রেফারেন্স, বা জিএসপি, বাণিজ্য সুবিধা হারিয়ে বাংলাদেশকে এসব উদ্বেগের মূল্য দিতে হয়েছে।
এসবের কারণে ইউ.এস. ডেভেলপমেন্ট ফাইন্যান্স কর্পোরেশন থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে বাংলাদেশ, যা যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা পূঁজি বিনিয়োগের একটি বিশাল উৎস।
আপনারা যেমনটি জানেন, এখন বাংলাদেশ প্রায় দশ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আশ্রয় দিচ্ছে, যারা বার্মায় নির্মম গণহত্যার কবল থেকে পালিয়ে এসেছে।
তাদের অব্যাহত উপস্থিতি একটি বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। রোহিঙ্গাদের নিরাপদ, স্বেচ্ছাধীন, মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবর্তনের জন্য বার্মার ওপর চাপ প্রয়োগ করা আমাদের সবার দায়িত্ব।
ততদিন পর্যন্ত, রোহিঙ্গা শরণার্থীরা যেন হারিয়ে যাওয়া প্রজন্মে পরিণত না হয় সে জন্য আমাদের সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
মৌলিক খাদ্য ও বাসস্থানের পাশাপাশি তাদের শিক্ষা, জীবিকা, ভালো স্বাস্থ্যসেবা ও নিরাপত্তা প্রয়োজন, যেন তারা বার্মায় ফেরার সময় নিজেদের তৈরি করে নিতে পারে।
যেসব চ্যালেঞ্জের কথা মাত্র তুলে ধরলাম সেগুলো কঠিন হলেও, আমার মনে হয়, বাংলাদেশ এরই মধ্যে যত চ্যালেঞ্জ জয় করেছে তার তুলনায় এগুলো নেহাতই ম্লান
আমি তৃতীয় যে বিষয়টি ওয়াশিংটনে গিয়ে বলবো তা হলো, আমি বিশ্বাস করি যে বাংলাদেশ গত ৫০ বছরে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে ভালো কোনো বন্ধু পায়নি। এবং আগামী ৫০ বছরেও এর চেয়ে ভালো বন্ধু পাবে না।
এবছর, ২০২২ সালে আমরা দুই দেশের মধ্যে বন্ধুত্বের ৫০ তম বার্ষিকী উদযাপন করছি।
১৯৭২ সাল থেকে, বাংলাদেশকে ৮০০ কোটি ডলার সহায়তা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
স্বাস্থ্য, কৃষি, শিক্ষা, গণতন্ত্র ও সুশাসন, জলবায়ু পরিবর্তন এবং বাংলাদেশের জনগণের জন্য আরও বেশি অর্থনৈতিক সুযোগ তৈরি সহ বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মসূচিতে, আমরা প্রতি বছর প্রায় ২০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করে যাচ্ছি।
কোভিড-১৯ সংকট শুরুর পর থেকে, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে প্রায় ১৪ কোটি ডলার কোভিড সহায়তা এবং ৬ কোটি ৪০ লাখ ডোজ কোভিড-১৯ টিকা দিয়েছে।
মজুত ও বিতরণ থেকে শুরু করে, নিরাপদে টিকা প্রদান পর্যন্ত জাতীয় টিকাদান অভিযানের প্রতিটি বিষয়ে আমরা সহায়তা করেছি।
আর বিষয় যখন নিরাপত্তা, তখন আমাদের সহযোগিতা গভীর ও বহুমুখী।
বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা প্রস্তুতিকে শক্তিশালী করতে, অপারেশনাল ইন্টারঅপারেবিলিটি গড়ে তুলতে এবং আমাদের সামরিক বাহিনীদের মধ্যে অংশীদারিত্ব জোরদার করতে- যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনী, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সঙ্গে অনুশীলন করে।
এছাড়াও আমরা বাংলাদেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকি।
মার্চ মাসে, আমি এখানে আসার পরপরই, আমরা ঢাকায় অষ্টম দ্বিপাক্ষিক অংশীদারিত্ব সংলাপ করেছি, যা আমাদের সম্পর্কের বৃহত্তর চিত্র, কৌশলগত বিষয়গুলোকে শক্তিশালী করতে সহায়তা করেছে।
এর কয়েক সপ্তাহ পর, ওয়াশিংটন দ্বিপাক্ষিক নিরাপত্তা সংলাপ আয়োজন করে। বৃহস্পতিবার, ২ জুন, আমরা একটি উচ্চ-পর্যায়ের অর্থনৈতিক পরামর্শ-সভা আয়োজন করব।
আমরা এরই মধ্যে সহায়তা-নির্ভর সম্পর্ক থেকে সরে গিয়ে পরস্পরের জন্য লাভজনক বাণিজ্য [সম্পর্কের] দিকে এগোচ্ছি।
আমি বিশ্বাস করি, আমাদের সম্পর্ক গভীর করার সবচেয়ে বড় সুযোগটি বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্পর্ক গড়ে তোলার মধ্যেই নিহিত।
যেমনটা আমি প্রায়ই বলি, আমাদের অংশীদারিত্বকে আরও দৃঢ়তর করতে বাংলাদেশ যত দ্রুত যেতে চায়, যুক্তরাষ্ট্রও ততটাই দ্রুত যেতে আগ্রহী।
জলবায়ু পরিবর্তন, গণতান্ত্রিক মূলনীতির প্রসার ও বাংলাদেশের চলমান অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মতো ইস্যুগুলো মোকাবিলার জন্য নতুন ও উদ্ভাবনী কর্মপন্থা চিহ্নিত করার পাশাপাশি বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ চালিয়ে যেতে, এবং খাদ্য নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য ও দারিদ্র্য বিমোচনে আমরা একসঙ্গে যে অগ্রগতি করেছি তার ওপর দাঁড়িয়ে আরও এগিয়ে যেতে, আমরা তৈরি আছি।
অসংখ্য ধন্যবাদ। প্রারম্ভিক বক্তব্য এখানেই শেষ, এখন আপনাদের প্রশ্ন নিতে পারলে খুশি হব।